সাইকেলের সামনের ঝুড়িতে কয়েকটি বই আর হ্যান্ডেলে ঝোলানো ব্যাগে গাছের চারা—এই নিয়ে গ্রামে গ্রামে ছুটে বেড়ান মাহমুদুল ইসলাম। চারা বিতরণের পাশাপাশি শিশুদের নিয়ে বসান পাঠের আসর। কখনো পরিষ্কার করছেন মাছ-মাংস বাজারের ময়লা, কখনো সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া কুকুর-বিড়ালকে সড়ক থেকে সরিয়ে মাটিচাপা দিচ্ছেন, কখনো কুড়াচ্ছেন পড়ে থাকা প্লাস্টিকের ব্যাগ, আবার কখনো সড়কের ধারের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করার পাশাপাশি অপসারণ করছেন সড়কে জমে থাকা বৃষ্টির পানি। প্রায় এক যুগ ধরে প্রতিদিন কাজগুলো করে যাচ্ছেন ৩৫ বছরের এই তরুণ।
২০১৩ সালে শুরু। রংপুরের কারমাইকেল কলেজে তখন বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়েন মাহমুদুল ইসলাম। মা-বাবার পাঠানো টাকা থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে নানা জাতের ফলদ আর বনজ গাছের চারা কেনেন। ছুটিতে তেঁতুলিয়ায় যাওয়ার সময় রংপুর থেকে সেসব নিয়ে যান। বাড়ির আশপাশে লাগান। একসময় নিজের গণ্ডি ছাড়িয়ে পুরো গ্রামকে নিয়েই ভাবতে থাকেন মাহমুদুল। নিজের টাকায় কেনা গাছের চারা স্থানীয়দের মধ্যে বিতরণ শুরু করেন। প্রিয় সাইকেলটি নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গাছের চারা বিতরণ শুরু করেন। পাশাপাশি দেন বই। পড়া শেষ হয়ে গেলে বদলে আবার অন্য বই দেন।
আকাশতলার পাঠশালা
২০১৬ সালে বাংলা সাহিত্যেই স্নাতকোত্তর শেষ করে বাড়িতে চলে আসেন মাহমুদুল। গাছ আর বই বিতরণ আরও বাড়িয়ে দেন। চাকরির পেছনে না ছুটে হতদরিদ্র, মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্কুলপড়ুয়া শিশুদের বাড়িতে বিনা মূল্যে পড়ান প্রতি সন্ধ্যায়। যার নাম দিয়েছিলেন ‘সন্ধ্যা রাতের পাঠশালা’। বিনা মূল্যে তাঁর কাছে পড়ালেখা শেখে শিশুরা। করোনার সময় গ্রামে গ্রামে গিয়ে শিশুদের নিরাপদ দূরত্বে বসিয়ে পড়ানো ও গল্পের বই পড়িয়ে শোনানো শুরু করেন। যার নাম দেন ‘আকাশতলার পাঠশালা’। এলাকার বিভিন্ন বয়সী মানুষের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ‘প্রকৃতির পাঠাগার’। সেখানে কয়েক হাজার বই আছে।
২০১৯ সালের ৬ জুলাই প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ তাঁকে নিয়ে ‘বই আর গাছ বিলান মাহমুদুল’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাঁকে পুরস্কৃত করে।
মাকে উৎসর্গ করেছেন পদক
পরিবেশদূষণ হবে না, এ জন্য বাইসাইকেলে চলাফেরা করেন মাহমুদুল। ব্যবহারের পর প্লাস্টিকের ব্যাগ মানুষকে মাটিতে ফেলতে দেখে খুবই ব্যথিত হন। মাঝেমধ্যে সাইকেলে করে এসব প্লাস্টিক ব্যাগ কুড়িয়ে বেড়ান। আগুনে পুড়লে সেখান থেকে বায়ুদূষণ হতে পারে, ভেবে এসব প্লাস্টিকের ব্যাগে গাছ আর সবজির চারা রোপণ করেন। এভাবে বাড়িতে গড়ে তুলেছেন গাছের বাগান। সেখান থেকে মানুষকে চারা বিতরণ করেন।
মা মাহমুদা বেগমের অনুপ্রেরণার পাশাপাশি এসব কাজে একসময় বাবা আজহারুল ইসলামের সহায়তা পেয়েছিলেন মাহমুদুল। ২০১৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর মায়ের সহযোগিতা নিয়েই এসব কাজ করছেন তিনি।
নিজের এসব কাজের অর্থ জোগাতে বাড়িতে হাঁস-মুরগি আর ছাগল পালন শুরু করেছেন মাহমুদুল। সেই সঙ্গে পুকুরে করেন মাছের চাষ। বাবার রেখে যাওয়া কিছু চা–বাগানেরও পরিচর্যা করেন। সম্প্রতি ছাগল বিক্রির টাকায় কিনেছেন নতুন কিছু বই।
মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এসব কাজকে অনেকে পাগলামি বলেন, অনেকে আবার বাঁকা চোখে দেখেন। মাকেও অনেক কথা শুনতে হয় এ জন্য। কেউ কেউ এসে মাকে বলেন, “এসব কী করছে আপনার ছেলে! ওকে বিয়ে দিবেন না?” এসব কথার কারণে অনেক আত্মীয়স্বজনের অনুষ্ঠানে যাওয়াও আমরা বাদ দিয়েছি।’
পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখার জন্য এবার ব্যক্তিপর্যায়ে ‘জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৪’ পাচ্ছেন মাহমুদুল ইসলাম। ২৫ জুন ঢাকায় এই পদক দেওয়ার কথা। তিনি বলেন, ‘অনুষ্ঠানে মাকে নিয়ে যেতে চাই। আর এই পদক আমি আমার মাকে উৎসর্গ করতে চাই। কারণ, মায়ের প্রেরণা ছাড়া এই কাজ আমি করতে পারতাম না।