লাল সবুজ ডেক্স
একজন প্রকৃত মুমিনের মূল কাজ হলো দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতেই সফলতা লাভ করা। অথচ আধুনিক সময়ে মানুষ সফলতার অর্থ বোঝে শুধু পদ-পদবি, অর্থ-সম্পদ, নাম-যশ, আর বাহ্যিক প্রতিষ্ঠায়। বাস্তবে এগুলো সাময়িক আর ক্ষণস্থায়ী সাফল্য, যার একটিও আখেরাতের জন্য ফলপ্রসূ নয়। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃত সফলতা বলতে বোঝায় এমন এক জীবনযাপন, যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে এবং কেয়ামতের দিন মুক্তির ঘোষণা পায়।
এ বাস্তবতা সামনে রেখে কোরআন ও সুন্নাহ বারবার আমাদের আত্মশুদ্ধির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আত্মশুদ্ধি হলো সেই গভীর আত্মিক সাধনা, যা মানুষকে তার প্রকৃত পরিচয় তথা একজন বান্দা হিসেবে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা দান করে। যে ব্যক্তি অন্তর পরিশুদ্ধ করে, প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে, সেই আসল সফলতার পথে এগিয়ে যায়।
আত্মশুদ্ধি শুধু ইবাদত-বন্দেগিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি ধারাবাহিক আত্মিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আল্লাহভীতি, অনুশোচনা ও তওবা, দোয়া, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, অন্তরের কঠোরতা দূর করা ইত্যাদি। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণী উল্লেখ করা হলো।
আল্লাহকে ভয় করা : আল্লাহভীতি মুমিন জীবনের মূলভিত্তি। মহান আল্লাহ যেমন ক্ষমাশীল তেমনি কঠোর শাস্তিদাতা। তাই অন্তরে সর্বদা আল্লাহর ভয় ধারণ করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে ইমানদানরা! তোমরা আল্লাহকে যথাযথ ভয় করো। আর মুসলমান না হয়ে কেউ মৃত্যুবরণ করো না।’ (সুরা আলে ইমরান ১০২) এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহকে যথার্থরূপে ভয় করতে হবে। আল্লাহভীতির আগুনে পুড়ে মানুষ যেমন প্রবৃত্তি ও কামনাকে ভস্মে পরিণত করতে পারে, তেমন আর কোনোভাবেই পারে না।
তওবা করা : তওবা আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো সঠিক পথে ফিরে আসা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হওয়া এবং আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করা। ইসলামি পরিভাষায় কোনো অন্যায় বা অপরাধমূলক কাজ হয়ে যাওয়ার পর অনুতপ্ত হয়ে সেই কাজের জন্য মহান প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং সেই অন্যায় কাজ ছেড়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ভালো পথে ফিরে আসাকে তওবা বলা হয়। কোনো কোনো মনীষী বলেন, অনুতাপ ও অনুশোচনা সহকারে গুনাহ বর্জন করে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করাকে তওবা বলে। তওবার মাধ্যমে অন্তরের কালিমা দূর হয়।
দোয়া করা : দোয়া শব্দের অর্থ আল্লাহর কাছে চাওয়া, প্রার্থনা করা। নিজের মনের সব আকুতি নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে মহান আল্লাহর কাছে কল্যাণ ও উপকার লাভের উদ্দেশে এবং ক্ষতি ও অপকার থেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রার্থনা করাই হলো দোয়া। কোরআন-হাদিসে দোয়াকেও ইবাদত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্তরের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা আবশ্যক। দোয়ার মাধ্যমে ইবাদতে নিমগ্ন হলে আত্মা প্রশান্তি লাভ করে। দোয়া হলো আল্লাহর কাছে চাওয়ার অপূর্ব ও অতুলনীয় মাধ্যম। দোয়া মুমিনের প্রাপ্তি ও মুক্তির হাতিয়ার। আল্লাহর দরবারে একাগ্রচিত্তে কাকুতি-মিনতিসহ দোয়া করলে কবুল হয়। দোয়া সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে বান্দার দোয়া অপেক্ষা অধিক মূল্যবান জিনিস আর কিছু নেই।’ (জামে তিরমিজি)
বান্দা আল্লাহর কাছে যত বেশি দোয়া করে, আল্লাহতায়ালা তাকে তত বেশি ভালোবাসেন এবং প্রার্থিত জিনিস দান করেন। আল্লাহতায়ালা নিজে তার বান্দাদের দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ (সুরা মুমিন ৬০) রাসুল (সা.) আত্মশুদ্ধির জন্য নিয়মিত দোয়া করতেন। তিনি দোয়ায় বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে পরিশুদ্ধ অন্তর কামনা করছি।’ (মুসনাদে আহমদ)
কোরআন তেলাওয়াত : কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে একজন বান্দার সঙ্গে মহান আল্লাহর কথোপকথন হয়। কোরআন মাজিদ মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী। এটি মানুষের প্রতি আল্লাহতায়ালার এক বিশেষ নেয়ামত। কোরআন হলো নুর বা জ্যোতি। আত্মার খোরাক এই কোরআন মাজিদ। যার প্রতি হরফে হরফে নেকি রয়েছে। কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মানুষের অন্তরের কালিমা দূর হয় এবং অন্তর প্রশান্ত হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই অন্তরেও মরিচা ধরে যেভাবে লোহায় পানি লাগলে মরিচা ধরে। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! এই মরিচা দূর করার উপায় কী? উত্তরে তিনি বলেন, মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করা এবং কোরআন তেলাওয়াত করা।’ (বায়হাকি)
জিকির করা : আল্লাহকে স্মরণ করার নাম জিকির। অন্তর ও জবান এই দুটি সব সময় আল্লাহর কাজে নিয়োজিত রাখাই জিকিরের উদ্দেশ্য। জিকির মানবাত্মার রোগ-ব্যাধি দূর করে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে। এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়ে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক বস্তুকেই পরিষ্কার করার যন্ত্র আছে। আর আত্মাকে পরিষ্কার করার যন্ত্র হলো আল্লাহর জিকির। (বায়হাকি) আল্লাহর জিকির হচ্ছে যাবতীয় ইবাদতের রুহ। তাই যত বেশি মহান আল্লাহর জিকিরে নিজেকে নিয়োজিত রাখা হবে অন্তর ততই পরিষ্কার হবে এবং অন্তরের রোগ-ব্যাধি দূর হবে। আল্লাহতায়ালা নিজেই মানুষকে বেশি বেশি জিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘জেনে রাখো! আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ ২৮)
অন্তরের কঠোরতা পরিহার : অন্তর কঠিন হওয়া মারাত্মক একটি রোগ। দীর্ঘ সময় মহান আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে থাকা এবং পাপকাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে মানুষের অন্তর কঠিন হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা থেকে দূরত্ব যত বেশি সেই হৃদয়ের কাঠিন্য তত বেশি। অন্তর কঠিন হলে মানুষের হৃদয়ে আল্লাহভীতি নষ্ট হয়ে যায়। যাদের অন্তর কঠিন ও আল্লাহভীতি শূন্য তাদের সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘দুর্ভোগ সেই লোকদের জন্য, যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তারা স্পষ্টত বিভ্রান্তিতে রয়েছে।’ (সুরা জুমার ২২) মহান আল্লাহ আমাদের অন্তরের কঠোরতা দূর করাসহ উল্লিখিত কাজগুলো করে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা অর্জনের তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখা: মাওলানা আশরাফুল ইসলাম