উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে উপমহাদেশে পদার্থবিজ্ঞানের গোড়াপত্তন হয়। অর্জিত হয় অনেকগুলো মাইলফলক। তাতে বাঙালি বিজ্ঞানীদের অবদান যথেষ্ট। যেসব বাঙালি পদার্থিবিজ্ঞানীর হাত ধরে উপমহাদেশে পদার্থবিজ্ঞানের যাতা শুরু হয়েছে, তাঁদের নিয়েই এই বই৷
বইয়ে মোট সাতজন পদার্থবিজ্ঞানীকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে৷ তাঁদের সবাই উপমহাদেশে পদার্থবিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে কাজ করেছেন। প্রত্যেকে চাইলে বিদেশে গিয়ে নিজেদের মতো করে গবেষণা করে আরও বিখ্যাত হতে পারতেন। পেতে পারতেন নোবেলও। কিন্তু তাতে উপমহাদেশে বিজ্ঞানচর্চা হয়তো শুরু হতো না। কিন্তু আসলেই কি এই বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানীরা নোবেল পাওয়ার মতো বড় বিজ্ঞানী ছিলন? চলো তাঁদের সম্পর্কে বই থেকে কিছু তথ্য জানা যাক। তারপর বিচারটা না হয় তুমিই করবে।
সাত পদার্থবিজ্ঞানীর মধ্যে প্রথমে রয়েছেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম পদার্থবিজ্ঞানী, পৃথিবীর প্রথম জীবপদার্থবিজ্ঞানী। বেতার যোগাযোগব্যবস্থায় উন্নতির জন্য ইতালীয় বিজ্ঞানী মার্কনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯০৯ সালে৷ কিন্তু তাঁ ন আই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন আমাদের জগদীশচন্্র বসু৷ িন্তু তিনি নোবেল পাননি। অবশ্য নোবেল না পাওয়ারও যথেষ্ট কারণ লেখক বইয়ে বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া উদ্ভীদের সংবেদনশীলতা নিয়েও প্রথমে গবেষণা করেন এই বাঙালি বিজ্ঞানী৷ এ জন্যই তো তিনি ইতিহাসের প্রথম জীবপদার্থবিজ্ঞানী। তাঁর বই ও গবেষণাপত্রের সংখ্যা ১৩৭। জন্ম, বেড়ে ওঠা, পরিবার— বিস্তারিত তুলে ধরেছেন লেখক৷ তবে বিস্তারিত শব্দটি শুনে ভাববেন না, লেখক ভূরি ভূরি তথ্য দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা ভরেছে৷ যতটুকু থ্য না দিলেই নয় ততটুকুই দিয়েছেন৷ বাক্যগুলো এমনভাবে সাজিয়েছেন, যেন শেষ না করে ওঠাই যাবে না।
এরপরে আছেন পদার্থবিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসু৷ স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর আপন ভাগ্নে৷ জগদীশচন্দ্র বসুর ছোট বোনের ছেলে৷ মামার মতোই মেধাবী৷ মহাজাগতিক রশ্মি, পারমাণবিক ও নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যায় গবেষণায় তাঁর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ তিনি প্রথম ফটোগ্রাফিক ইমালশন পদ্ধতিতে মেসনের ভর নির্ণয় করেছলেন৷ বিদেশে গবেষণার সুযোগ হলেও তিনি দেশ তাগ করে যাননি৷ তাঁর পদ্ধতি ব্যবহার করে সিসিল পাওয়েল বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৫০ সালে৷ দেবেন্দ্রমোহন ও বিভা চৌধুরী যৌথভাবে একই পদ্ধতিতে গবেষণা করেছিলেন পাওয়েলের আগে৷ বলা ভালো, তাঁদের দেখাদেখিই পাওয়েল একই পদ্ধতিতে গবেষণা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ভালো ফটোগ্রাফিক প্লেট না থাকার কারণে পূর্ণাজ্ঞ গবেষেণা করতে পারেননি দেবেন্দ্রমোহন ও বিা চৌধুরী৷ রে একই পদ্ধতিতে উন্নত প্লেট ব্যবহার করে সফল হন পাওয়েল৷ যদিও এই দুই বাঙালিকে কৃত্রিত্ব দিতে ভোলেননি পাওয়েল। শুধু ফটোগ্রাফিক প্লেটের অভাবে আরও একটি নোবেল হাতছাড়া হয়ে যায়। দেবেন্দ্রমোহনকে তাই মামার মতোই দুর্ভাগা বললেও হয়তো ভুল হবে না৷
শিশিরকুমার মিত্র। বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ারের বিভিন্ন স্তরের অস্তিত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ তিনিই প্রথম করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতা-পদার্থবিজ্ান বিভাগের সূচনাও হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। ৯৬ র সরকর তাঁকে পদ্ূষণ উপাধীতে ভূষিত করেন। একই বছর তিনি জাতীয় অধ্যাপক হন। তাঁর বই ও গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৫৫।
বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানের আরেক দিকপাল মেঘনাদ সাহা। বিশ্বে যতজন বিজ্ঞানীর মৌলিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে উঠেছে, মেঘনাদ সাহা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর সাহা সমীকরণ প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে। এরপর ১৮ বছে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে যত গবেষণা হয়েছে, তার প্রায় সব কটিতে ব্যবহৃত হয়েছে সাহা সমীকরণ। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর, এনরিকো ফার্মি, ম্যাক্স বর্ন, আর্থার এডিংটনের মতো বিজ্ঞানীরা মেঘনাধ সাহার প্রতিভার কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু এমন জ্ঞানী বিজ্ঞানীর শৈশব ছিল অত্যন্ত কষ্টে জর্জরিত। বাবা তাঁকে স্কুলে পাঠাতেন দোকানের সামান্য হিসাব রাখার জন্য, বিজ্ঞানী বানানোর জন্য নয়। প্রাইমেরি শেষ করতে না করতেই বন্ধ হতে বসেছিল পড়ালেখা। সেখান থেকে কীভাবে তিনি হয়ে উঠলেন বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীদের একজন, তা এই বইয়ে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন প্রদীপ দেব।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সম্পর্কে সবার কমবেশি জানা। আইনস্টাইনের সঙ্গে মিলে একাকার হয়ে আছে সত্যেন বসুর নাম। ইলেকট্রন ও ফোটনের মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য আছে, তাঁর গাণিতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সত্যেন বসুর হাে। পৃথিবীর সব মৌলিক কণকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর একটির বাম ফার্মিয়ন এবং অন্যগুলোর নাম বোসন। পদার্থবিজ্ঞানী ইনরিকো ফার্মির সম্মানে কণাগুলোর নাম রাখা হয়েছে ফার্মিয়ন। আর সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও আইনস্টাইনের নামের সম্মানে নামকরণ করা হয়েছে বোসন কণা। কিন্তু কেন? তা বিস্তারিত জানতে বইটি পড়তে হবে।
বিশ শতকের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম স্টিফেন হকিং। তাঁর গবেষণার ভিত্তি গড়ে উঠেছে যসব মৌলিক সমীকরণের ওপর ভিত্তি করে, সেখানে প্রথম দিকেই আছে রায়চৌধুরী সমীকরণ। এই সমীকরণের আবিষ্কারক অমলকুমার রায়চৌধুরী। স্টিফেন হকিং নিজের থিসিসে প্রথম রায়চৌধুরীর সমীকরণ ব্যবহার করেছিলেন। এর পর থেকে সেই সমীকরণ মহাবিশ্বের রহস্য সন্ধানে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। তাঁ বা য় বাংলার ইনস্টাইন বাংলার মানুষ ভালোবেসে তাঁকে এই নাম দিয়েছেন। কিন্তু অমলকুমার রায়চৌধুরী স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন। তাঁর শৈশব, বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে গবেষণা—সব বিষয় খুব সুন্দর ও সহজ ভাষায় উঠে এসেছে এই বইয়ে।
তালিকার শেষ নামটি জামাল নজরুল ইসলাম। পৃথিবীর প্রথম সারির পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন তিনি। মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে সত্তরের দশকে হাতে গোনা যে কয়টি বই প্রকাশিত হয়েছিল, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের লেখক ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আব্দুস সালাম নজরুল ইসলামের মধ্যে দেখেছিলেন নোবেল পাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু বিদেশে সব ছেড়ে তিনি মাটির টানে চলে এলেন বাংলাদেশে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তুললেন আন্তর্জাতিক গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। সে কাজটাও সহজ ছিল না। অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়ে কাজটা করতে হয়েছে তাঁকে।
এই সাত নক্ষত্রকে নিয়ে যিনি লিখেছেন, তাঁর নাম প্রদীপ দেব। সুলেখক হিসেবে পরিচিত। এর আগেও জীবনীগ্রন্থ রচনা করে নিজের মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। এই বইয়েও সে ধারা বজায় রেখেছেন তিনি। যারা নিয়মিত বিজ্ঞানচিন্তা পড়েন, তাঁরা ইতিমধ্যে লেখকের অসংখ্য লেখা সম্পর্কে অবগত আছেন। তাঁর ভাষা অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল। যেকোনো বয়সের মানুষই বইটি পড়ে তৃপ্তি পাবেন। প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে প্রত্যেক বিজ্ঞানীর প্রকাশিত বই ও গবেষণাপত্রের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলা বইয়ে সাধারণত এমনটা দেখা যায় না। সঙ্গে প্রতি অধ্যায়ে বিস্তারিত তথ্যসূত্র জুড়ে দিয়েছেন। কেউ চাইলে সেসব তথ্য থেকে বিজ্ঞানীদের ম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন। বিষয়টা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
তবে সব ভালোর মধ্যেও টীকার ব্যাপারটা একটু দৃষ্টিকটু লেগেছে। প্রতি অধ্যায়ে (একেকজন বিজ্ঞানীকে নিয়ে একেকটা অধ্যায়) একাধিক টীকা চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন হয়তো পড়তে পড়তে দেখলাম কোথাও টীকা হিসেবে ১২ লেখা আছে। তার পরের পাতায় আবার ১২। ঠিক পরের পাতায় আবার ১। এগুলো লেখক তথ্যসূত্র, প্রকাশিত ব বা সম্পাদিত বইয়ের জন্য হয়তো লাদা আলাদা করে টীকা ব্যাবহার করেছেন। কিন্তু াঠক হিসেবে একটু লে িতে পারে কন সংখ্যা দিয়ে কী বোঝানো হয়েছে, তা আমার বুঝতে একটু সমস্যা হয়েছে। তবে টীকার ব্যাপারটি মাথায় না নিয়েও সুন্দরভাবে পড়তে পারবে বইটি। এ জন্য কোথাও বাধা পাবে না।