

“এই যে দেখছেন, এখান থেকে বছর দুই আগেও আমাদের ঘরটা ছিল। এখন সব মেঘনার পেটে। আর মাত্র কয়েকটা দিন, এই ঐতিহাসিক মাতব্বর বাড়িটাও শেষ। আমাদের পূর্বপুরুষদের শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও আর থাকবে না।” ভাঙনের কিনারায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার মাতব্বর। তার দু’চোখে অসহায়ত্ব আর শূন্যতা।
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার মেঘনা নদীর পাড় এখন শুধুই ভাঙনের করুণ গল্প। প্রতিদিন একটু একটু করে নদী তার থাবায় গিলে নিচ্ছে বসতভিটা, ফসলের মাঠ, মসজিদ, স্কুল— জীবিকার প্রতিটি চিহ্ন। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে এই উপজেলার সাদেকপুর, রুকুন্দি ও আশপাশের গ্রামের দৃশ্য আরও যেনো ভয়াবহ হচ্ছে। এক সময়ের বসতিপূর্ণ জনপদগুলো এখন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

এক সময় যার খ্যাতি ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর, আজ তার পরিচয় কেবলই নদী ভাঙনের “ভয়াবহ দৃশ্য” হিসেবে। বিশেষ করে বর্ষাকালে নদী ফুঁসে ওঠে আর হাজার হাজার মানুষের ভিটেমাটি কেড়ে নেয়।
শুধু ঘরবাড়ি নয়, মেহেন্দিগঞ্জ এর নদী ভাঙ্গন কেড়ে নিচ্ছে জনসাধারণের ভবিষ্যৎও। একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর মসজিদ বিলীন হয়ে যাওয়ায় বহু শিশু পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়ছে। ছেলে শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে নেমে পড়ছে জীবিকার সন্ধানে, আর মেয়েরা শিকার হচ্ছে বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক ব্যাধির। সামাজিক সমস্যার এই চক্র যেন শেষ হওয়ার নয়।
অর্থনৈতিকভাবেও এই জনপদ ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, গাছপালাসহ অন্যান্য অবকাঠামো ধ্বংস হওয়ায় মানুষের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে। গবেষণামূলক তথ্য অনুযায়ী (CEGIS, 2019), বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। কেবল ভাঙনের কারণেই প্রতি বছর প্রায় এক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় প্রায় ২৫ কোটি মার্কিন ডলার (প্রথম আলো, ২০২২)।

হারানো মানচিত্রের শঙ্কা
২০১৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (BWDB) মেহেন্দিগঞ্জকে দেশের অন্যতম ভয়াবহ ভাঙনপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে। মেঘনা, ইলিশা, মাছকাটা, তেঁতুলিয়া ও কালাবাদুর নদীর তীব্র ভাঙনের মুখে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে মেহেন্দিগঞ্জের ভৌগোলিক আয়তন। স্থানীয়দের আশঙ্কা, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে মেহেন্দিগঞ্জের বহু অংশ অচিরেই বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।
ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষদের দিন কাটছে চরম দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তায়। স্থানীয়দের এখন একটাই দাবি, অবিলম্বে নদী তীর সংরক্ষণের জন্য স্থায়ী ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তা না হলে এই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ আর অসহায়ত্ব কেবল বাড়তেই থাকবে, যে অসহায়ত্ব প্রতিনিয়ত প্রশ্ন রেখে যায়, “আর কতটুকু বিলীন হলে রাষ্ট্রের দৃষ্টি পড়বে?”