

বাংলাদেশে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এখনো একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এটি একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া হলেও, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত কুসংস্কার, লজ্জা এবং ভুল তথ্যের কারণে এটি একটি ‘নিষিদ্ধ’ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, আমাদের দেশের কিশোরী ও নারীরা যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে, তেমনি তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, বিশেষ করে শিক্ষা, মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ইউনিসেফ-এর তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশের প্রায় অর্ধেক স্কুলগামী মেয়ে তাদের প্রথম মাসিক শুরু হওয়ার আগে এ বিষয়ে কিছুই জানতো না, যার কারনে তাদের মনে তৈরি করেছিল ভয় এবং বিভ্রান্তি।
নিকিতা ইসলাম (২৬) নামের এক তরুণীর অভিজ্ঞতা যেন এই বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। তিনি বলেন, “যখন আমার প্রথম মাসিক হয়, আমি ভেবেছিলাম আমার কোন গুরুতর অসুখ হয়েছে। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কারণ কেউ আমাকে এ বিষয়ে আগে সচেতন করেনি। যদি বাবা-মা ও স্কুলগুলো কন্যাশিশুদের আগে থেকেই এ বিষয়ে শিক্ষা দেয়, তাহলে তারা বুঝতে পারবে যে মাসিক একটি স্বাভাবিক ঘটনা এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে এই পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার জন্য আরও ভালোভাবে প্রস্তুত থাকতে পারবে।
এই নীরবতা ভাঙতে এবং একটি সুস্থ ও সম্মানজনক পরিবেশ তৈরি করতে ইউনিসেফ সরকার, বিভিন্ন অংশীজন, স্কুল, পরিবার ও সমাজের সঙ্গে যৌথভাবে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে। এই পদক্ষেপগুলো কেবল স্বাস্থ্য সুরক্ষাই নিশ্চিত করছে না, বরং মাসিককে ঘিরে থাকা সামাজিক ট্যাবু দূর করে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস ও শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে সাহায্য করছে।
১. জরুরি পরিস্থিতিতে সমন্বিত মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা বা ভূমিধসের সময় যখন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে, তখন মাসিক স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা যেন একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এমন সংকটকালে নারী ও মেয়েদের গোপনীয়তা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ইউনিসেফ সংকটপূর্ণ এলাকাগুলোতে বিশেষভাবে তৈরি ‘ডিগনিটি কিট’ বিতরণ করে। এই কিটে প্রয়োজনীয় স্যানিটারি প্যাড, সাবান, অন্তর্বাস এবং রাতে ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য একটি টর্চ ও বাঁশি থাকে। এছাড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত বা দীর্ঘমেয়াদি বাস্তুচ্যুতি পরিস্থিতিতে থাকা কমিউনিটিগুলোর মধ্যে ইউনিসেফ মাসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ওরিয়েন্টেশন সেশন (পরিচিতিমূলক সেশন) পরিচালনা করে, যার মাধ্যমে নারী ও কন্যাশিশুরা কঠিন পরিবেশেও নিরাপদে মাসিক সামলানোর পদ্ধতি জানতে ও প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। এর বাইরে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরেও, ইউনিসেফ কিশোরীদের পুনঃব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছে যা তাদের জরুরি প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধি, পরিবেশের সুরক্ষা এবং আয়ের উৎস তৈরিতে সহযোগিতা করছে।
২. নীতি প্রণয়ন ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম
অপর্যাপ্ত জ্ঞান ও অনিরাপদ স্বাস্থ্যবিধির কারণে মেয়েরা প্রজনন ও মূত্রনালি সংক্রমণের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। ইউনিসেফের উদ্যোগে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাসিক স্বাস্থ্য পণ্য সহজলভ্য করার পাশাপাশি সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়েও শিক্ষা দেওয়া হয়। এই লক্ষ্যে ইউনিসেফ প্রতি বছর ‘মাসিক স্বাস্থ্য দিবসে’ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে যার মূল লক্ষ্য হলো জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরি করা, লজ্জা দূর করা এবং মেয়েদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলা।
২০২১ সালে ইউনিসেফ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মিলে জাতীয় মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কৌশল তৈরি করে। এখন সেই কৌশল বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা হচ্ছে। এই কৌশলের কেন্দ্রে রয়েছে কন্যাশিশু ও ছেলেদের স্কুলের পাঠ্যক্রমে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভুক্ত করা, মাসিক স্বাস্থ্যবিধির পণ্য সকলের জন্য সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করা এবং এগুলো বাস্তবায়নের জন্য সমাজ, সরকার ও বেসরকারি খাতকে একত্রে নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্র তৈরী করা।
৩. মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
মাজিক লজ্জা এবং নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন স্থানের অভাবে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ শতাংশ মেয়ে প্রতি মাসে মাসিকের কারণে গড়ে ২.৫ দিন স্কুল কামাই করে। এতে মেয়েরা শেখার, বেড়ে ওঠার ও সাফল্য অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। ইউনিসেফ এই অবস্থার পরিবর্তনে কাজ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যখন স্কুলগুলোতে উন্নত ও জেন্ডার-সংবেদনশীল ওয়াশরুম (পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা) সুবিধা থাকে, তখন মেয়েদের স্কুল অনুপস্থিতি ১৫ শতাংশ কমে যায় এবং শিশুদের মধ্যে পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ প্রায় এক চতুর্থাংশ কমে আসে। এই সমস্যা সমাধানে ইউনিসেফ সরকারের সহায়তায় স্কুল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ‘হাইজিন কর্নার’ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক মডেল টয়লেট নির্মাণ করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সহায়তায় বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিনও বসানো হয়েছে, যাতে জরুরি মুহূর্তে প্যাড পাওয়া যায়।
৪. ক্ষতিকর কুসংস্কার ও প্রচলিত সামাজিক রীতি ভেঙে দেওয়া
আমাদের সমাজে মাসিক নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, যেমন: “রান্না করা যাবে না”, “তোমার স্কুলে যাওয়া উচিত নয়”, “বাইরে রোদে কাপড় শুকাতে দিও না”, “মাসিক নিয়ে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলো না”, “মাসিকের রক্ত কিন্তু বিপজ্জনক” ইত্যাদি। ইউনিসেফ এই ধরনের ক্ষতিকর কুসংস্কারগুলো ভাঙতে কাজ করে। তারা শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও মাসিক সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে। শওকত ওসমান শিশির (২৫) বলেন, “যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন জানতাম না যে মাসিকের সময় পেটব্যথা হয়। যদি জানতাম, তাহলে হয়তো আমি নারী ও মেয়েদের প্রতি আরও বেশি সহানুভূতিশীল হতে পারতাম।” তার এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, মাসিক শিক্ষা নারী-পুরুষ সবার জন্য জরুরি।
অনলাইনে আলোচনা এবং তথ্য আদান-প্রদান:
ইউনিসেফ ইন্টারনেটের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ‘মাসিকবান্ধব’ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো তরুণ-তরুণীদের জন্য একটি নিরাপদ স্থান যেখানে তারা নির্ভয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে পারে।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে এখনও মাসিক একটি ট্যাবু, সেখানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো মুখোমুখি আলোচনার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী। কারণ এতে নাম প্রকাশ না করেও অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে, সহপাঠীদের মাধ্যমে শেখার পরিবেশ তৈরি হয় এবং বৃহৎ পরিসরে মাসিককে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে তুলে ধরা যায়। শহর ও গ্রাম উভয় এলাকায় ইন্টারনেট সুবিধার প্রসারের ফলে এসব অনলাইন আলোচনা তরুণ প্রজন্মকে আরও সচেতন ও সহানুভূতিশীল করে তুলছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে এমন একটি প্রজন্ম গড়ে উঠছে যারা জানে, মাসিক কোনো লুকানোর মতো গোপন বিষয়