

“কলেজিয়েট অভিধান” অনুসারে “বৈচিত্র্য” শব্দটির অর্থ হলো বিভিন্নতা। বিভিন্নতা অনেক কিছুরই হতে পারে। এটি হতে পারে পরিবর্তনশীল আবহাওয়ায়, খাবারের স্বাদে, অথবা হয়তো ভিড়ের মাঝে ফিসফিস করে বলা অসংখ্য ভাষায়। আমার জন্য বৈচিত্র্যের পুরো সংজ্ঞাই সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর। এই দেশের প্রতিটি অংশেই চরম বৈচিত্র্য রয়েছে, এবং এই বৈচিত্র্য যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন পটভূমি থেকে আসা নানা ধরনের মানুষের আগমনের মাধ্যমে। এই বৈচিত্র্য হলো বিভিন্ন মানুষের, তাদের বিভিন্ন জ্ঞান ও চিন্তার বৈচিত্র্য। যদিও প্রায় সব স্টেটেই ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে, তাদের মধ্যে নিউ ইয়র্ক সিটি সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়। নিউ ইয়র্ক সিটি এতটাই বৈচিত্র্যময় যে, এই শহর কীভাবে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এত মিলিয়ন মানুষকে আকৃষ্ট করেছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। আমি একজন স্থানীয় নিউ ইয়র্কার। একজন নিউ ইয়র্কার হিসেবে, আমি এই শহরের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ শেয়ার করতে চাই, যা বৈচিত্র্যের প্রতীক হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত।
নিউ ইয়র্ক সিটিতে আসার আগে আমি কখনোই কল্পনা করিনি এই শহর কেমন, এমনকি কখনো ভাবিওনি এই শহর সম্পর্কে। বাংলাদেশে সবকিছু ছেড়ে আসার দুঃখে আমি কোথায় যাচ্ছি তা নিয়ে কোনো গবেষণাও করিনি। যেদিন রাতে আমি এই শহরে পৌঁছালাম, বৈচিত্র্যের তীব্র ঢেউ আমার বন্ধুদের ছেড়ে আসার দুঃখ ভুলিয়ে দিল। চারপাশের কোলাহল, এয়ারপোর্টে আত্মীয়দের নাম ধরে ডাক, শীতের আগমনে ঠান্ডা বাতাস, সব মিলিয়ে পরিবেশে এক গভীর পরিবর্তনের অনুভূতি তৈরি করেছিল।
এই সব অনুভূতির মধ্যে সবচেয়ে তীব্র ছিল বৈচিত্র্যের অনুভূতি। এয়ারপোর্টে আত্মীয়দের ডাকছিলেন যারা, তারা শ্বেতাঙ্গ ছিলেন না, অথচ আমি ভেবেছিলাম আমেরিকা শুধু শ্বেতাঙ্গে পূর্ণ। কিন্তু আমি যা দেখছিলাম তা ছিল ভিন্ন, চারপাশে এত এশীয়, দক্ষিণ এশীয়, এবং কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, আর সত্যি বলতে খুব কম সংখ্যক শ্বেতাঙ্গই ছিল। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে আমার ট্যাক্সি চালক ছিলেন একজন বাংলাদেশি-আমেরিকান, যিনি ঢাকার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন আমি আশেপাশের আকাশচুম্বী ভবন দেখে কেমন অনুভব করছি, কিন্তু আমি এতটাই বিস্মিত ছিলাম যে প্রথমে তার প্রশ্নই শুনিনি।
পরদিন আমি এমন একটি জায়গায় গেলাম যা আমি কখনোই যাওয়ার কথা ভাবিনি, কিন্তু ইন্টারনেটে দেখেছিলাম এটি বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় এলাকা, যেখানে ১৬০টিরও বেশি ভাষা বলা হয় এবং ৬০% বাসিন্দা বিদেশে মানে আমেরিকার বাহিরে জন্মগ্রহণ করেছেন। তারা পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশ থেকে এসেছে এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশিরা সেখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায়। সেই জায়গার নাম “জ্যাকসন হাইটস”। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম যখন দেখলাম একটি রাস্তার নাম ‘বাংলাদেশ স্ট্রিট’, যা জ্যাকসন হাইটসের অংশ। সেই মুহূর্তের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
জ্যাকসন হাইটস সম্পর্কে আরেকটি আকর্ষণীয় তথ্য হলো, এখানে সবাই অন্তত দুটি ভাষা বলতে পারে। আমিও তাদের একজন। আমি পাঁচটি ভাষা বলি: ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, উর্দু এবং স্প্যানিশ (অল্প)। এই বৈশিষ্ট্য এখানে প্রায় সবার মধ্যেই দেখা যায়। আমি এমন স্থানীয়দেরও দেখেছি যারা ব্যবসায় লাভের জন্য অনেক ভাষা শিখেছেন। মোটের উপর, এই জায়গাটি আমার মতো পটভূমির মানুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কেন্দ্র। আমি বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া খুব বেশি যাই না, কারণ এটি খুবই ভিড়পূর্ণ এলাকা।
যেদিন আমি প্রথম স্কুলে গেলাম, সেটি ছিল আমার জীবনের আরেকটি অধ্যায়। সেদিন আমি প্রথমবারের মতো এত দেশ থেকে আসা এত মানুষকে একসঙ্গে দেখলাম। আমার প্রথম স্কুলটি ছিল অভিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য। তাই সেখানে কোনো শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থী ছিল না, কিন্তু সব শিক্ষকই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ এবং তারা আমার জীবনের সেরা শিক্ষক ছিলেন। যেমনটি বলেছি, আমার স্কুলটি অভিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল, সেখানে এমন দেশ থেকে মানুষ ছিল যেগুলোর নাম আমি আগে শুনিনি এবং তারা এমন ভাষায় কথা বলত যা আমি আগে কখনো শুনিনি।
আমি মনে করি, এত শিক্ষার্থীর সঙ্গে থাকার সবচেয়ে ভালো দিক হলো আমি তাদের দেশ সম্পর্কে সত্য জানতে পারি কোনো বাধা ছাড়াই। আমি আমার বার্মিজ, চাইনিজ, আফ্রিকান, পুয়ের্তো রিকান এবং আরও অনেক বন্ধুর কাছ থেকে এমন অনেক গোপন তথ্য জেনেছি যা মিডিয়া কখনো প্রকাশ করে না। আমি তাদের তথ্য গোপন রাখব, কিন্তু যে জ্ঞান আমি পেয়েছি তা আমাকে বৈচিত্র্যের গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করেছে।
এই পৃথিবীর সব কিছুরই ভালো এবং খারাপ দিক আছে, বৈচিত্র্যেরও কিছু খারাপ দিক আছে। আমি কয়েকটি নিয়ে কথা বলব, তবে আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই যে আমি বৈচিত্র্যকে চরমভাবে ভালোবাসি। এই মতামতগুলো শুধুই কিছু সাধারণ অসুবিধা যা পৃথিবীর অনেক জায়গায় দেখা যায়। প্রথম বিভ্রান্তি আসে যখন আপনি নতুন এই এলাকায় আসেন। আমি মনে করি যখন আমি প্রথম এখানে এসেছিলাম, আমি এত ভিন্ন সংস্কৃতি দেখে খুব বিভ্রান্ত ছিলাম, যদিও পরে তা কেটে যায়। আমি অন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও শুনেছি যে বিভ্রান্তি যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবার আসা যেকোনো মানুষের জন্য সাধারণ। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কয়েক মাস আমার জন্য খুব কঠিন ছিল কারণ আমি কাউকে চিনতাম না এবং আমার কোনো প্রকৃত বন্ধু ছিল না যার সঙ্গে আমি কথা বলতে পারতাম। সময়ের সঙ্গে তা সেরে যায়, কিন্তু সেই বিভ্রান্তির সময়টা যেন যুগের মতো মনে হয়েছিল।
আরেকটি বড় চাপ আমি অনুভব করেছিলাম, তা হলো চরম প্রতিযোগিতা। আমার আগের লেখায় আমি এটি নিয়ে কিছুটা বলেছি, আর তা হলো যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিযোগিতা কতটা তীব্র, কারণ এই দেশ বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনেক স্কলারশিপ দিয়ে আকৃষ্ট করে, তাই তারা অবশ্যই খুবই বুদ্ধিমান। আবার এটি কিছু মানুষের জন্য ভালো হতে পারে, কিন্তু সবার জন্য নয়।
তবুও, এত ভিন্ন মন ও আত্মার সঙ্গে থাকার ফলে আমি অনেক গভীরভাবে পরিবর্তিত হয়েছি। এটি আমার দৃষ্টিভঙ্গি, আমার লক্ষ্য এবং আমার উদ্দেশ্যকে বদলে দিয়েছে। আমি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে সম্মান করতে শুরু করেছি এবং তাদের অসাধারণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে শুরু করেছি। আমি এমন অনেক কিছু শিখেছি যা শুধু বই পড়ে শেখা সম্ভব নয়। আমি দেখেছি কিভাবে ভিন্ন ঐতিহ্য আমার ঐতিহ্যকে দেখে। আমি জেনেছি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে আমরা বাংলাদেশিরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি শ্রমজীবী মানুষের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছি এবং জেনেছি তারা কতটা পরিশ্রমী। আমি জেনেছি কিভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন দেশের মানুষকে শুধুমাত্র মানবতার কারণে নিজের পরিবারের মতো ভালোবাসা যায়। আমি শিখেছি ভাষার বাধা আমাদের কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা প্রকাশে বাধা দেয় না এবং ভাষাই একমাত্র প্রকাশের মাধ্যম নয়।
নিউ ইয়র্কাররা হয়তো একটু বুনো, আর এই শহর আমাদের মানিব্যাগকে পৃথিবীর যেকোনো জায়গার চেয়ে দ্রুত ফাঁকা করে দেয়। নিউ ইয়র্ক সত্যিই সব দিক থেকেই ব্যয়বহুল। কিন্তু দিনের শেষে, এই শহরকে সত্যিকার অর্থে মূল্যবান করে তোলে না তার আকাশচুম্বী অট্টালিকা, না ঝলমলে আলো, এমনকি সেই নিরন্তর ব্যস্ততাও নয়, বরং এটি হলো তার বৈচিত্র্য। শত শত ভাষার মেলবন্ধন, নানা জাতির মানুষের অবাধ বিচরণ, এই শহরকে পৃথিবীর অন্য সব শহর থেকে আলাদা করে তোলে। বৈচিত্র্যই নিউ ইয়র্কের প্রাণ। জীবনের এবং জীবনধারার যে চরম বৈচিত্র্য এখানে বিরাজমান, সেটাই নিউ ইয়র্ক সিটিকে “দ্য বিগ অ্যাপল” নামে পরিচিত করেছে |