

সকালের শহর তখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। কিন্তু বরিশাল নগরীর শিল্পকলা একাডেমির তৃতীয় তলার আর্ট গ্যালারিতে তখন ভোরের আলোয় ভরপুর এক আলাদা উচ্ছ্বাস নিয়ে একঝাঁক তরুণ। হাতে নোটপ্যাড-কলম, চোখেমুখে অনুপ্রেরণার দীপ্তি ও শেখার উদ্যম, ১৬ থেকে ২৪ বছরের তরুণ-তরুণীরা ভিড় জমিয়েছে এক স্বপ্ন নিয়ে। তারা এসেছে নেতৃত্ব শেখা, নিজেদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য।
আর সেই স্বপ্নের নাম, ‘লার্ন টু লিড’’, আর স্বপ্ন পূরণের সারথী লাল সবুজ সোসাইটি।
সামাজিক সংগঠন লাল সবুজ সোসাইটি’র উদ্যোগে আয়োজিত এই দিনব্যাপী নেতৃত্ব বিকাশ কর্মশালাটি যেন এক নতুন প্রজন্মের পরিবর্তনের বিদ্যাপীঠ। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সেশন, আলোচনা, দলীয় কাজ, গেম, হাসি,আনন্দে মুখর থাকে পুরো দিনটি।
শুধু বরিশালেই যে এমন আয়োজন হয়েছে তা নয়। লাল সবুজ সোসাইটির উদ্যোগে লার্ন টু লিড দেশের ঢাকা, পটুয়াখালী, রংপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এই কর্মশালার আয়োজন করে শত শত তরুণদের নেতৃত্ব অর্জনে দক্ষ করে গড়ে তুলছে।
দিনব্যাপী এই আয়োজনে লাল সবুজ সোসাইটি তরুণদের মাঝে নেতৃত্ব বিকাশের নানা পন্থা, বার্তা, বাস্তবিক উদাহরণ, দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো শিক্ষা, দ্বন্দ্ব নিরসন, সহানুভূতি, যোগাযোগ ও সম্পর্ক এবং নেতৃত্বের পথে যাত্রা শেখায় বক্তৃতা, খেলাধুলা, দলীয় কার্যক্রম, রোল-প্লে, আলোচলা ও ইন্টারেক্টিভ সেশনের মাধ্যমে
নেতৃত্ব: পদ নয়, মনোভাব ও সাহস
দিনব্যাপী এই কর্মশালাগুলোতে শুরুতেই আলোচনা হয় নেতৃত্ব নিয়ে।
লাল সবুজ সোসাইটির প্রতিষ্ঠা ও সভাপতি তাহসিন উদ্দিন বলেন, নেতৃত্ব কোনো পদ নয়, এটি একটি মনোভাব। নিজের দায়িত্ব নেয়ার সাহসই নেতৃত্বের শুরু।’
বরিশাশের কর্মশালায় এই এক লাইন যেন হয়ে উঠে দিনের প্রতিটি সেশনের প্রাণ। প্রশিক্ষকরা একে একে তরুণদের শেখান, কীভাবে কথা বলার আগে শুনতে হয়, কীভাবে দলকে বোঝাতে হয়, কীভাবে একটি সিদ্ধান্তের পেছনে দায়িত্ব নিতে হয়।
শেখা, ভাবনা আর বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গি
‘লার্ন টু লিড’ এ অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থী আফরিন তাসনিম বলেন,
“আমি আগে ভাবতাম নেতৃত্ব মানে শুধু বক্তৃতা দেওয়া। কিন্তু আজ বুঝলাম, এটা হলো শোনার, বোঝার আর একসাথে পথ চলার শিল্প।”
অন্যদিকে সাইদুল ইসলাম–এর মুখে শোনা গেল এক অন্য উপলব্ধি,
শুধু আফরিনই নন, ঢাকা, পটুয়াখালী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লার্ন টু লিডে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা মনে করে, একজন ভালো নেতা হতে হলে ভালো টিম প্লেয়ার হতে হয়, দায়িত্ববান, ভালো শ্রোতাও হতে হয়। এই প্রশিক্ষণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে।
শেখায় ফিডব্যাক গ্রহণের উপযোগিত
‘লার্ন টু লিড’ এ আলোচনা, ইন্টারেক্টিভ করতে করতে নানা কার্যক্রমের ফিডব্যাক গ্রহণ করে নেয়া হয়। যা কোনো তরুণের নেতৃত্ব বিকাশের গুণকে বাড়িয়ে তোলে। তরুণ উদ্যমীরা তাদের সমালোচনা, ত্রুটি গ্রহণ করতে শেখে এই কার্যক্রমের মাধ্যমে।
পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী আল হাদি বলেন, “নেতৃত্বের ধরন, ভালো ও খারাপ নেতার পার্থক্য আর ফিডব্যাকের গুরুত্ব খুব দারুণভাবে বুঝতে পেরেছি। ফিডব্যাককে বার্গারের সঙ্গে তুলনা করার ধারণাটা আমি জীবনে কাজে লাগাতে চাই।”
শেখার সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন
প্রতিটি আয়োজনে দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ ও নেটওয়ার্কিং সেশনে তরুণরা একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেয় তাদের লক্ষ্য, স্বপ্ন ও সামাজিক ভাবনা কিংবা জীবনের অর্জন ও আকাঙ্ক্ষা। কারও চোখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন, কারও কণ্ঠে নেতৃত্বের অঙ্গীকার। কেউ হয়তো প্রথমবার বুঝছে, নেতৃত্ব মানে শুধু অন্যকে পথ দেখানো নয় বরং একসাথে সবাই মিলে এগিয়ে যাওয়া।
শুধু তাই নয়, প্রতিটি অনুষ্ঠানে আগত আলোচক, প্রশিক্ষক কিংবা অতিথির সাথেও সম্পর্ক ও নেটওয়ার্কিং তৈরি হয় প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে যা তাদের ভবিষ্যতকে আলোকিত করবে।
নেতৃত্বের আলোর যাত্রা
লাল সবুজ সোসাইটি চায় তরুণরা যেন শুধু নিজেদের নয়, কমিউনিটি ও সমাজেরও পরিবর্তন ঘটায়। বরিশাল, পটুয়াখালী, ঢাকা কিংবা রংপুর- আলাদা শহর, আলাদা আয়োজন কিন্তু লক্ষ্য একটাই, তরুণদের অন্তরে নেতৃত্বের আলোক শিখা প্রজ্বলিত করা এবং তা দৃশ্যমান ও দীর্ঘমেয়াদি করা।
আয়োজনের আয়োজক এবং স্বেচ্ছাসেবকরা বলেন, আমরা চাই তরুণরা শুধু নিজেদের উন্নয়ন নয়, সমাজে নেতৃত্ব দিক। ভবিষ্যতে নিয়মিতভাবে এমন কর্মসূচি আয়োজনের পরিকল্পনা আছে।”
তরুণদের ভেতরে পরিবর্তনের উদ্যম:
‘লার্ন টু লিড’’ শুধুমাত্র একটি প্রশিক্ষণ নয় বরং একটি পরিবর্তনের সূচনা। এখানে নেতৃত্ব শুধু বক্তৃতায় শেখা হয়না বরং শেখা হয় অভিজ্ঞতায়; শেখা হয় দায়িত্ব নিতে, শুনতে, অনুভব করতে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহসী পদক্ষেপ নিতে।
লাল সবুজ সোসাইটি বিশ্বাস করে, পরিবর্তনের যাত্রা শুরু করতে শুধু বক্তৃতা নয়, দরকার সঠিক দিকনির্দেশনা, পারস্পরিক বোঝাপড়া আর মানবিকতার মন্ত্রে গড়া শিক্ষা।