

ঢাকার আকাশে তখন শ্রাবণের গাঢ় মেঘ। হালকা বৃষ্টিতে শহরটা যেন ধুয়ে-মুছে প্রস্তুত হচ্ছিল নতুন কোনো সম্ভাবনায়। সেই সম্ভাবনার সূচনা হয় ৪ জুলাই, সকাল ৯টায়, মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ায় অবস্থিত এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেল্থ প্রশিক্ষণ কক্ষে৷ দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা ৩০ জন তরুণ-তরুণী অংশ নেন এক বিশেষ সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ‘জেন-জি মিডিয়া ক্যাম্প-২০২৫’। আয়োজক সংগঠন লাল সবুজ সোসাইটি বিশ্বাস করে, সাংবাদিকতা কেবল পেশা নয়- এটি একটি দায়িত্ব, পরিবর্তনের হাতিয়ার। এই ক্যাম্পে তরুণরা শিখছিলেন- কেবল সংবাদ লেখা নয়, শিখছিলেন ভাবা, প্রশ্ন করা, আর দায়িত্বের সঙ্গে গল্প বলা।
কেউ ক্যামেরার সামনে সংকোচে, কেউ নোটবুকে নতুন ভাষার খোঁজে, তবু সবার চোখে ছিল এক অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা: “শিখতে এসেছি, বদল আনতে চাই।” শ্রাবণের মতোই তারা এসেছিল ধূসর সময় রাঙাতে। আর সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছিল একটি নতুন গল্প, ‘জেন-জি মিডিয়া ক্যাম্প-২০২৫’।
প্রথম দিনের সকাল: যারা এসেছে গল্প খুঁজতে চারপাশে শ্রাবণের স্নিগ্ধতা, আর লালমাটিয়ার একটি প্রশিক্ষণকক্ষে তখন জমে উঠছে নিরব অথচ গভীর এক সকাল। ৩০ জন তরুণ-তরুণী বসে আছেন সারি করে। কারও হাতে কলম, কারও হাতে মোবাইল৷ তাদের প্রত্যেকেই এসেছেন গল্প খুঁজতে, শিখতে কীভাবে শব্দে রূপ দেওয়া যায় বাস্তবকে।
গাইবান্ধার প্রত্যন্ত চর এলাকা থেকে আসেন জহিরুল ইসলাম, পঞ্চগড় থেকে রনি মিয়াজী, বান্দরবান থেকে খোয়াই সিং নু মার্মা, রাঙ্গামাটি থেকে আসেন প্রঞ্জাধনী চাকমা৷ এছাড়াও দেশের নানান জেলা থেকে প্রশিক্ষণার্থীরা আসেন৷ যারা পূর্বে কেউ কাউকে চিনত না৷ কিন্তু এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা একে ওপরের সাথে পরিচিত হয়৷ অংশগ্রহণকারী অনেকের সাংবাদিকতার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই৷ আছে শুধু আগ্রহ আর প্রবল ইচ্ছেশক্তি৷ চোখে-মুখে জেদ- আমরাও পারি, আমরাও লিখতে পারি সত্যের গল্প।
সকালটা শুরু হয়েছিল ইউএনডিপি-এর প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা মো: আব্দুল কাইয়ুমের সেশনের মধ্য দিয়ে৷ তিনি তার সেশনে সমাজ পরিবর্তনের জন্য গণমাধ্যমের ব্যবহার বিষয়ে আলোচনা করেন৷ এছাড়াও যুবকদের গণমাধ্যমে মানবাধিকার শিখন এবং মানবাধিকার সম্পর্কে বুনিয়াদি ধারণা প্রদান করেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের উপ পরিচালক ফারহানা সাঈদ৷ তিনি অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘প্রশিক্ষণার্থীদের অংশগ্রহণ স্বতস্ফুর্ত ছিল৷ মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জানার আগ্রহ খুবই ইতিবাচক৷ উক্ত আয়োজনের মাধ্যমে মানবাধিকার সচেতন জেন-জি গড়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস৷
কমিউনিটি সাংবাদিকতার প্রাথমিক ধারণা নিয়ে পরবর্তী সেশনটি নেন সিনিয়র সাংবাদিক রফিকুল মন্টু। তিনি বলেন, “সাংবাদিকতা মানে স্টুডিওতে বসে বিতর্ক নয়—সাংবাদিকতা মানে মাঠে যাওয়া, মানুষের কথা শোনা। সত্যের খোঁজে অনেক সময় একা হতে হয়, দাঁড়াতে হয় সবার বিপরীতে। আর সেই একাকীত্বেই গড়ে ওঠে সত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী গল্প।”
সারাসেশনজুড়ে ছিল পিনপতন নীরবতা। কারও মনে হচ্ছিল, কথাগুলো যেন ঠিক তারই জন্য বলা৷ আফতাব মন্টু যেন ভাষা দিয়েছেন তারই জীবনের না-বলা অভিজ্ঞতাকে।
দ্বিতীয় দিন: সাংবাদিকতা শেখা হয় মাটির গন্ধ মেখে ৫ জুলাই। সকাল থেকেই লালমাটিয়া এনজিও ফোরাম সেন্টারের পরিবেশ যেন একটু ব্যতিক্রম। সবার চোখেমুখে উত্তেজনা, কাঁধে ব্যাগ, হাতে কলম আর ফোন। আজ আর কেবল বসে শেখা নয় বরং আজ শেখা হবে হাঁটতে হাঁটতে, মাটি ছুঁয়ে, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে।
ফিল্ড ওয়ার্ক সাংবাদিকতা প্রশিক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আজ অংশগ্রহণকারীরা ছড়িয়ে পড়বে মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া ও আদাবরের বিভিন্ন এলাকায়। সেখান থেকে সংগ্রহ করবে বাস্তব গল্প, তৈরি করবে ক্ষুদ্র রিপোর্ট, যেটি হবে তাদের শেখা কথাগুলোর প্রথম বাস্তব প্রয়োগ।
রনি মিয়াজীর দল যায় আদাবরের একটি বস্তিতে। টিনের ছাউনি আর সরু গলির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছে যায় ফাহিমা বেগমের ঘরে। ফাহিমা বেগম যিনি তিন সন্তান নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন সংসার। এক বেলার খাবার নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও ফাহিমার কণ্ঠে ছিল আশার আলো।
অন্যদিকে, বর্ধন মার্মার দল খোঁজ পান এক ১৬ বছরের কিশোরীর, যার বাড়ি একটি অন্ধকার ভেজা ঘর। ছোট্ট একটি মোবাইলেই সে চলছে অনলাইন ক্লাস করে, চোখে তার মেডিকেল ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন। চারপাশে টিকটিকি, তেলাপোকা, ঘরের স্যাঁতসেঁতে দেয়াল কিন্তু মেয়েটির চোখে দৃঢ়তা, আর ঠোঁটে অটুট উচ্চারণ, “আমি ডাক্তার হব।”
প্রতিটি গল্প যেন অনুরণিত হতে থাকে প্রশিক্ষণার্থীদের হৃদয়ে। তারা বুঝতে শেখে সাংবাদিকতা মানে শুধু সংখ্যা নয়, পরিসংখ্যান নয়। এটি মানুষের ভাঙা-গড়া, হেরে গিয়েও জিতে ওঠার গল্প বলা। এটি চোখে চোখ রেখে শ্রদ্ধাভরে কথা শোনা।
দিন শেষে সবাই ফিরে আসে ক্যাম্পে। ক্লান্ত কিন্তু বদলে যাওয়া চোখে। সেদিনের সন্ধ্যায় ডিবিসি নিউজের কনটেন্ট প্রডিউসার শোভন মদক তার নিদিষ্ট সেশনে বলেন, “গল্প বলতে সাহস লাগে। সেই সাহসটা তোমাদের ভেতরেই আছে। শুধু জানতে হবে, কোথায় দাঁড়ালে বেশি মানুষ শুনবে।”
তৃতীয় দিন: সত্য আর সাহসের পথে ‘লাল সবুজ প্রকাশ’-এর সূচনা এবং সাংবাদিক সম্মাননা৷
তিনদিনব্যাপী জেন-জি মিডিয়া ক্যাম্প-২০২৫’-এর শেষ দিনটি ছিল আবেগ, গর্ব আর নতুন সম্ভাবনার এক মহাসমারোহ। ৬ জুলাই বিকেলে রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনে অনুষ্ঠিত হয় ‘লাল সবুজ প্রকাশ’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। এই আয়োজনে চূড়ান্ত রূপ পেল লাল সবুজ সোসাইটির প্রথম তরুণভিত্তিক মিডিয়া ইনিশিয়েটিভ একটি সাহসী যাত্রার সূচনা।
প্রকাশ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল জুলাই ছাত্র আন্দোলনে সাহসিকতার সাথে গণমাধ্যমে দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকদের সম্মাননা প্রদান। ছয়জন সাংবাদিককে এই সাহসিকতার স্বীকৃতি জানিয়ে লাল সবুজ সোসাইটি তুলে দেয় “জুলাই সাংবাদিক সম্মাননা”।
সম্মাননাপ্রাপ্ত সাংবাদিকরা হলেন যমুনা টেলিভিশনের রিপোর্টার লামিয়া সুলতানা তিতি, বিশেষ প্রতিনিধি আখলাকুর সাফা, চিটাগং সেন্টারের ভিডিও জার্নালিস্ট সাইদুল রশিদ ইভান, দৈনিক সমকালের তাসনিম মহসিন, মানবজমিনের ফটো সাংবাদিক জীবন আহমেদ। তাদের প্রত্যেকেই গত জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া ছাত্র গণআন্দোলনের সময় মাঠে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সংবাদ পরিবেশনে পিছপা হননি। তরুণ প্রশিক্ষণার্থীদের চোখে এই সম্মাননা যেন সাহসিকতার আলোকবর্তিকা৷ যা দেখিয়ে দেয়, সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো কখনো একা চলা নয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ (পি.আই.বি)-এর মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ। তিনি বলেন,“এই তরুণরাই আগামী দিনের চোখ। ওরা সত্য বলবে, ভয়কে পাশে সরিয়ে। লাল সবুজ সোসাইটির এই উদ্যোগ আমাদের বিশ্বাস জোগায় যে, সাহসের উত্তরাধিকার থাকবে সঠিক হাতে।”
উৎসবের এক পরতে ছিল প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর জন্য বিশেষ এক চমক। ক্যাম্প শেষে সবাই হাতে পেয়েছে একটি করে মিডিয়া কিট এবং একটি করে অঙ্গীকারপত্র। অঙ্গীকারপত্রে লেখা ছিল: “আগামী ১২ মাসে অন্তত ৫টি নাগরিকমুখী রিপোর্ট তৈরি করবে, নিজের এলাকা থেকে, নিজের ভাষায়।”
এই প্রতিশ্রুতি এক নীরব শপথ। একজন তরুণ এখন শুধু ইউটিউবার বা কনটেন্ট ক্রিয়েটর নয়, বরং হয়ে উঠবে গ্রামের গল্পকার, শহরের কণ্ঠস্বর, জনপদের সাংবাদিক। ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া জ্ঞান-সাহসকে সম্বল করে এখন তারা রিপোর্ট করবে নিজ উঠানে, ক্লাসরুমে, ইউনিয়ন হলরুমে কিংবা মাঠে ঘাটে। ভিডিও করবে, সাক্ষাৎকার নেবে, সত্য বলবে। তাদের প্রতিবেদন হয়তো পত্রিকায় প্রকাশ পাবে না, কিন্তু মানুষের মুখে মুখে পৌঁছাবে। এই হলো ‘লাল সবুজ প্রকাশ’-এর মূল দর্শন।
লাল সবুজ সোসাইটির এই আয়োজন তাই ছিল শুধু এক উৎসব নয়, বরং ছিল একটি স্বপ্নের আত্মপ্রকাশ।