

ড. মুহাম্মদ তোয়াব হোসেন ও মো. হাসানুজ্জামান: লেখকদ্বয় শিক্ষক ও গবেষক
ছাত্রনেতৃত্বে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এক অভূতপূর্ব ঘটনা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই গণঅভ্যুত্থান শুধু একটি ঘটনাই নয়– এটি ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ শক্তি, সামাজিক চেতনা এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামোর রূপরেখা তৈরি করতে গণঅভ্যুত্থানের একাডেমিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এই প্রবন্ধে আমরা সামাজিক গঠনবাদ ও ব্যবস্থা তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করব কীভাবে ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা ও চেতনাকে শিক্ষাখাতের সংস্কারে পথনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করা যায় এবং ভবিষ্যৎ সংকটে রাষ্ট্রকাঠামো কীভাবে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারে।
আধুনিক শিক্ষায় ‘সামাজিক গঠনবাদ’ একটি প্রভাবশালী তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, জ্ঞান, বাস্তবতা এবং পরিচয় কোনো স্থির বা প্রাকৃতিক বিষয় নয়, বরং এগুলো মানুষের পারস্পরিক সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে তৈরি হয়। এটি এমন একটি তত্ত্ব, যা বলে যে, মানুষের জ্ঞান, মূল্যবোধ এবং বিশ্বাস তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ দ্বারা নির্মিত হয়। সোশ্যাল কনস্ট্রাকটিভিজম অনুযায়ী, ব্যক্তিরা একে অপরের সঙ্গে আলোচনা, বিতর্ক এবং সহযোগিতার মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করে। ভাষা ও সংস্কৃতি– এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জুলাই অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা সামাজিক গঠনবাদের বাস্তব উদাহরণ। এখানে দুটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, সামাজিক বাস্তবতার পরিবর্তন। গণঅভ্যুত্থানের আগে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং ক্ষমতা কাঠামোকে সমাজের একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিবাদ, স্লোগান এবং সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে নতুন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় পূর্বে স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত অনেক কিছু যেমন– কোটা ব্যবস্থা, দমনমূলক আইন এবং ক্ষমতা কাঠামোর প্রতি মানুষের ধারণার পরিবর্তন আসে। দ্বিতীয়ত, সামষ্টিক জ্ঞান নির্মাণ। আন্দোলন চলাকালীন মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, আলোচনা এবং ব্যক্তিগত মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একে অপরের কাছ থেকে তথ্য এবং ধারণা লাভ করে। গুজব, মিথ্যাচার ও সরকারি প্রোপাগান্ডার বিপরীতে জনগণের মধ্যে একটি ‘সামষ্টিক জ্ঞান’ তৈরি হয়, যা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে সাহায্য করে।
অন্যদিকে, ডেভিড ইস্টনের ব্যবস্থা তত্ত্ব অনুযায়ী, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে পরিবর্তিত জ্ঞান ও ধারণা পরিবেশের মধ্যে নতুন নতুন দাবি সৃষ্টি করে; যা উদ্ভূত বাস্তবতা ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডার দ্বারা সমর্থিত হয়। এই দাবি ও সমর্থন (ইনপুট) যথাযথ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি প্রণয়ন (আউটপুট) করা জরুরি হয়ে পড়ে। সেই নীতি বাস্তবায়নের পর নাগরিকদের ফিডব্যাক ও পরবর্তী পরিবেশ পর্যালোচনায় রাখতে হয়।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ফলে বৈষম্যের যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় সেই ধারণা সুনির্দিষ্ট দাবিতে পরিণত হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দাবির যথাযথভাবে প্রক্রিয়াকরণ না হওয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং নাগরিক সমাজের সমর্থন লাভ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নীতি ও কৌশলের পরিবর্তে সরকার পুরোনো দমনমূলক ক্ষমতার প্রয়োগ করে এবং ফিডব্যাক হিসেবে জনরোষ তৈরি হয়। একপর্যায়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয় ও গণঅভ্যুত্থান ঘটে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সামাজিক বাস্তবতা ও শিক্ষা-পরিবেশে পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনা ও বৈষম্যবিরোধী সচেতনতা তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমে গুজব, প্রোপাগান্ডা, ফেইক নিউজের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টি ও শৃঙ্খলাভঙ্গের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। তাই পরিবর্তিত বাস্তবতার আলোকে শিক্ষায় একুশ শতকের দাবি ও শিক্ষার্থীদের চাহিদা পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে শিক্ষা অন্যতম ক্যাডার। ক্যাডার কম্পোজিশন রুলস অনুযায়ী, শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সব কার্যক্রম শিক্ষা ক্যাডারের তত্ত্বাবধানে হওয়ার দাবি রাখে। এ লক্ষ্যেই বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিসিএসের মাধ্যমে ক্যাডারভিত্তিক মেধাবী, দক্ষ ও যোগ্য লোক নিয়োগের সুপারিশ করে। কিন্তু এ ক্যাডারের কার্যপরিধি সীমিত করার মাধ্যমে সিভিল সার্ভিসের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও আন্তঃবৈষম্যের সুযোগ রাখা হয়েছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাস্তবতায় শিক্ষা খাতের সংস্কারে এ বিষয়টা গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারের ভিশন-মিশন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও কাঙ্ক্ষিত মানবসম্পদের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার উদ্দেশ্যের সঙ্গে দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষক ও শ্রেণিকার্যক্রমকে একীভূত করতে হবে। সঠিক নীতি ও কৌশলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামষ্টিক ধারণার ইতিবাচক পরিবর্তন ও শিক্ষা প্রশাসনের মধ্যে ব্রিজ তৈরি করতে পারলে শিখন-কার্যক্রম সফলতা পাবে।
শ্রেণিকার্যক্রম এবং শিক্ষা-প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় সোশ্যাল কনস্ট্রাকটিভিজম তত্ত্বের কার্যকর প্রয়োগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে শিক্ষা ক্যাডার। কারণ শুধু শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই এমন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারেন, যা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং সহযোগিতাকে উৎসাহিত করবে। শিক্ষা-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষানীতি, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে একুশ শতকের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষণ-পদ্ধতি, দক্ষতা ও কৌশল সংযোজন করতে হবে। সামাজিক গঠনবাদ তত্ত্বের আলোকে, শ্রেণিকক্ষে দলগত কাজ, আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। যখন শিক্ষার্থীরা একে অপরের সঙ্গে তাদের ধারণা এবং অভিজ্ঞতা ভাগ করে, তখন তাদের শেখা আরও গভীর হয়। তাই কেবল নীতিগত সিদ্ধান্ত নয়, বাস্তবে শ্রেণিকক্ষে সক্রিয় শিখন, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা উৎসাহিত করতে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক কৌশল প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এসব কার্যক্রম হতে হবে সমন্বিত বা সামগ্রিক পদ্ধতিতে, যেখানে সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শদানের ব্যবস্থা থাকবে।
এ লক্ষ্যে পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষা কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তকে। সোশ্যাল কনস্ট্রাকটিভিজম তত্ত্বের আলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এমন কারিকুলাম প্রণয়ন করতে পারে, যেখানে মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে সমস্যা সমাধান, গবেষণা এবং দলগত কাজকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারিকুলামে এমন বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের কেবল তথ্য গ্রহণকারী হিসেবে নয়, বরং জ্ঞানের নির্মাতা হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেবে। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে পারবে। একইসঙ্গে প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে উৎসাহিত করবে।
পাঠ্যপুস্তক এমনভাবে ডিজাইন করা উচিত, যেখানে সরাসরি তথ্য প্রদানের চেয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে, ভাবতে এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ দিতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই জ্ঞানের গভীরে যেতে পারবে। পরিবর্তন আনতে হবে মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও। মুখস্থনির্ভর পরীক্ষার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের তাদের ধারণা, বিশ্লেষণ এবং সৃজনশীলতার ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করতে হবে।
পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি এনসিটিবি শিক্ষকদের জন্য এমন সহায়ক গাইড তৈরি করবে, যা শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে সোশ্যাল কনস্ট্রাকটিভিজম পদ্ধতি ব্যবহার করে পড়াতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন কর্মশালা এবং পেশাগত উন্নয়ন কর্মসূচির আয়োজন করতে হবে; যাতে শিক্ষকরা নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারেন এবং শ্রেণিকক্ষে তা প্রয়োগ করতে পারেন।
উপর্যুক্ত নীতি ও কৌশল বাস্তবায়নের পর শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মতামত জানানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধের সামাজিক প্রভাব অবগত হওয়া যাবে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে অন্যান্য সামাজিক বাস্তবতা– যেমন দারিদ্র্য, বেকারত্ব, পেশাগত বৈষম্য শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকদের মধ্যে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, সেটাও মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখতে হবে। এতে জুলাই বিপ্লবের জনআকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হবে।
শিক্ষা ক্যাডারের নেতৃত্বে মন্ত্রণালয়, মাউশি, এনসিটিবি, নায়েম, নেপ ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার সমন্বিত ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপই শিক্ষাব্যবস্থায় সোশ্যাল কনস্ট্রাকটিভিজম তত্ত্বের সফল প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারে, যার মাধ্যমে জুলাই বিপ্লবের কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা-দক্ষতাভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব হবে। এ ধরনের সমাজে প্রত্যেকেই সমান সুযোগ পাবে এবং তাদের প্রতিভাকে বিকশিত করে সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখবে।