ভূমিকম্প শব্দটার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। বেড়ে ওঠার সাথে সাথে এ নামটার সাথে আমাদের বাস্তবিক অর্থেও সাক্ষাৎ মেলে। এ ভূমিকম্প যেন এক আতংকের নাম। পৃথিবীর ভূমির কম্পনই সাধারণ অর্থে ভূমিকম্প। তবে একাডেমিক ভাষায় বলতে গেলে, পৃথিবীর ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীড়নের ফলে এক ধরনের শক্তির সঞ্চয় হয়, এই শক্তি হঠাৎ মুক্তি পেলে ভূ পৃষ্ঠ কিছুটা সময়ের জন্য কেঁপে উঠে ও ভূ-ত্বক এর কিছুটা আন্দোলিত হয় আর এই ক্ষণস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প বলা হয়ে থাকে।
ভূমিকম্পে বিশ্বের বহুদেশে বড় বড় দুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশের বহুবার ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সম্প্রতি সর্বশেষ ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলা। এতে অন্তত দশজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ভূমিকম্পে আহত হয়েছেন অনেকে, এদের মধ্যে আতংকিত হয়ে হতাহতের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ভূমিকম্পের যদিও কোনো আগাম বার্তা নেই, তাই ভূমিকম্প হলে থাকতে হবে সচেতন, সতর্ক ও গ্রহণ করতে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ।
ভূমিকম্প বিষয়ক সতকর্তায় বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এই দুর্যোগ মোকাবেলায় বেশকিছু করণীয়’র কথা উল্লেখ করেছে। চলো জেনে নেয়া যাক,
ভূমিকম্পের পূর্বে যে করণীয় ব্যবস্থা নিবে,
- ভূমিকম্প সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য অবহিত হতে হবে এবং পরিবারের সদস্যদের তা অবহিত করা।
- ভূমিকম্প নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেয়া এবং প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান পরিবারের সদস্যদের তা অবহিত করা।
- ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা, ভূমিকম্পের ঝুঁকি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া ও পরিবারের সদস্যদের অবহিত করা।
- ভূমিকম্পকালীন আশ্রয়স্থলের জন্য উপযুক্ত স্থান সম্পর্কে ধারণা নেয়া এবং পরিবারের সদস্যদের তা জানানো।
- গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের সংযোগ ঝুঁকিমুক্ত কি-না তা নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে।
- জরুরি অবস্থায় বাড়ির পাশের ফাঁকা জায়গা পরিবারের সকলকে দেখিয়ে রাখতে হবে।
- ঘরের ভারী আসবাবপত্র যাতে ভূম্পিকম্পে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা না ঘটাতে পারে, সেজন্য পেছন থেকে আংটা লাগিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে রাখতে হবে।
- ভূমিকম্পের সময় নিজেকে নিরাপদ রাখার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে শুকনো খাবার, পানি ও প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী সংরক্ষণ করতে হবে।
- মনে রাখবে ভূমিকম্প নিজে মানুষকে আঘাত করে না। মানুষের তৈরি ঘর-বাড়ি বা দুর্বল স্থাপনা, অবকাঠামো ভেঙে পড়ায় মানুষ হতাহত হয়।
- বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুসরণ করে ভবন নির্মাণ করতে হবে, ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস করতে হবে।
- ফায়ার স্টেশন, হাসপাতাল/ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহের টেলিফোন নম্বর বাড়ির প্রকাশ্য ও দৃশ্যমান স্থানে লিখে রাখতে হবে।
- বহুতল ভবন, মার্কেট, হোটেল/বিদ্যালয়ের সিড়ি প্রশস্ত করতে হবে এবং জরুরি মুহূর্তে তা বাধাহীনভাবে ব্যবহারের উপযোগী রাখা জরুরি।
- যথাযথ সচেতনতা এবং প্রস্তুতি ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি আশানুরূপভাবে কমাতে পারে।
ভূমিকম্পের সময় করণীয়
- অনুভূত হলে শান্ত থাক। যদি ভবনের নিচ তলায় থেকে থাকো, তাহলে দ্রুত বাইরে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসতে হবে।
- যদি ভবনের উপর তলায় থাক, তাহলে কক্ষের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়া জরুরি।
- ভূমিকম্পের সময় বিছানায় থাকলে, বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে নিতে হবে; অতঃপর টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোন আসবারের নিচে আশ্রয় নেয়া প্রয়োজন এবং তা এমনভাবে ধরে থাকা যেন মাথার উপর থেকে সরে না যায়। এছাড়া শক্ত দরজার চৌকাঠের নিচে ও পিলারের পাশে আশ্রয় নিতে পার।
- উচু বাড়ির জানালা, বারান্দা বা ছাদ থেকে লাফ দেবে না।
- রান্নাঘরে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে আসতে হবে। সম্ভব হলে বাড়ির বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মেইন সুইচ বন্ধ করে দিবে।
- দুর্ঘটনার সময় লিফট ব্যবহার করবে না।
- ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে থাকবে।
- গাড়িতে থাকলে ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে গাড়ি থামাতে হবে। ভূকম্পন না-থামা পর্যন্ত গাড়ির ভেতরেই থাকতে হবে।
- ভূমিকম্পের প্রথম ঝাঁকুনির পর পুনরায় ঝাঁকুনি হতে পারে। সুতরাং একবার বাইরে বেরিয়ে এলে নিরাপদ অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত ভবনে পুনরায় প্রবেশ করবে না।
- মোবাইল বা ফোন ব্যবহারের সুযোগ থাকলে উদ্ধারকারীদের তোমার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবে।
- তুমি যদি কোন বিধ্বস্ত ভবনে আটকা পড় এবং তোমার ডাক উদ্ধাকারীগণ শুনতে না পায় তাহলে বাঁশি বাজিয়ে অথবা হাতুড়ি বা শক্ত কোন কিছু দিয়ে দেয়ালে বা ফ্লোরে জোরে জোরে আঘাত করে উদ্ধাকারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করতে হবে।
- ভাঙ্গা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়া-চড়ার চেষ্টা করবে না। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে হবে এবং উদ্ধাকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে হবে দ্রুত।
ভূমিকম্প পরবর্তীকালে করণীয়
- ভূমিকম্পে একবার কম্পন হওয়ার পর আবারো কম্পন হতে পারে। তাই প্রথমবার অনুভূত কম্পন থেমে যাওয়ার পর ঘর থেকে সিঁড়ি দিয়ে সারিবদ্ধভাবে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নিতে হবে।
- গ্যাস বা অন্য কোন রাসায়নিক দ্রব্যের গন্ধ পেলে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
- বৈদ্যুতিক খুঁটি, টেলিফোনের খুঁটি ও তার উঁচু দেয়াল ও ভবন থেকে দূরে অবস্থান করতে হবে।
- বাইরে থাকলে দুর্যোগ শেষে সরকারিভাবে নিরাপদ ঘোষণা আসার পর বা সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত সংস্থার মাধ্যমে নিরাপত্তার বিষয়ে অবহিত হওয়ার পর ভবনে প্রবেশ করবে।
- জরুরি তথ্য পাওয়ার জন্য রেডিও ব্যবহার করা যেতে পারে।
- একটি ভূমিকম্পের পর আরও ভূকম্পন হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত ভবন, ব্রিজ ও বিভিন্ন অবকাঠামো থেকে দূরে থাকবে। কারণ পরবর্তী ভূকম্পনে সেগুলো ধসে যেতে পারে।
- কেউ অসুস্থ হলে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
- উদ্ধার কাজে তৎপর সংস্থাসমূহকে সহযোগিতা করতে হবে।
প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ নিজেকে নিরাপদ রাখার অন্যতম প্রধান পন্থা। প্রশিক্ষণ নাও, নিজেকে নিরাপদ রাখ। এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের মাত্রা অনেকটাই কমে যাওয়া সম্ভব। তাই এ করনীয় মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।