/
/
নিরবে পরিবেশের ক্ষতি করছে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার তেজস্ক্রিয়তা
নিরবে পরিবেশের ক্ষতি করছে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার তেজস্ক্রিয়তা
Byরুশাইদ আহমেদ
Published১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
১:৫৩ অপরাহ্ণ
আরইউএস_21
রুশাইদ আহমেদ
রুশাইদ আহমেদ অধ্যয়ন করছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। উন্নয়ন, মানবাধিকার, যোগাযোগ, ভূরাজনীতিসহ বিবিধ বিষয়ে তিনি দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে নিয়মিত লেখালেখি করে থাকেন। সাংবাদিকতা এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ওপরও রয়েছে তাঁর তুমুল ঝোঁক।

কনটেন্টটি শেয়ার করো

Copied!

সর্বশেষ

net

এ বছর জানুয়ারিতে প্রযুক্তি বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন ‘কুলেস্ট গ্যাজেট’ এক প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্বের প্রায় ৭২০ কোটি মানুষ বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। এদের মধ্যে বহু ব্যবহারকারীর আবার রয়েছে একাধিক ফোন। এসব ফোনে ব্যবহৃত হচ্ছে নানা ধরনের মোবাইল নেটওয়ার্ক।

এই ডিভাইসের নানাবিধ সুবিধা যেমন, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা, স্থান-কাল ভেদে সর্বত্র ফটো ও ভিডিওগ্রাফি করা, সুদৃঢ় কলিং নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা, দৈনন্দিন প্রয়োজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারসহ অগণিত সুবিধা এই ডিভাইসটিকে করে তুলেছে আধুনিক মানুষের নিত্যকার সঙ্গী। এমনকি মোবাইল ফোনই যে এখনকার সর্বাধিক ব্যবহৃত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সে বিষয়েও আর সন্দেহ পোষণ করছেন না বহু প্রযুক্তিবিদ। এর বিভিন্ন ফিচারে প্রতিনিয়তই মুগ্ধ হচ্ছে পৃথিবীর সকল ব্যবহারকারীরা।

স্মার্টফোনের এই জনপ্রিয়তায় ইতিমধ্যে বিশ্বে ২০২৮ সাল নাগাদ স্মার্টফোন উৎপাদন খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৬ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে বলে আভাস দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ডাটা কর্পোরেশন। যা পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি বিপণনকারীদের ব্যাপক হারে অত্যাধুনিক স্মার্টফোন বাজারজাত অব্যাহত রাখার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকার বিষয়টিকে দৃশ্যমান করে তোলে। আপাতদৃষ্টিতে দারুণ লাগলেও এখানেই ঘটছে বিপত্তি।

বিজ্ঞানের অন্যসব আবিষ্কারের মতো স্মার্টফোনেরও সুবিধার পাশাপাশি নানাবিধ অপকারিতা আছে। ব্যবহারকারীদের অপব্যবহারের অবাধ সুযোগ এবং উৎপাদনকারীদের অযাচিত মুনাফাপ্রীতির কারণে মোবাইল ফোন তাই এখন সরাসরি পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মানবদেহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে মোবাইল নেটওয়ার্কের শক্তিশালী তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের (ইএমএফ) উচ্চ তেজস্ক্রিয় তরঙ্গ বিকিরণ মাত্রা এবং পুরোনো ফোনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাব সংকটটির জন্য অভিশাপ হয়ে উঠছে।

নানা সময়ে বিভিন্ন আলোচনায় বাংলাদেশ কিংবা উপমহাদেশীয় এলাকাগুলোতে পুরোনো ফোনের ইলেকট্রনিক বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু আলাপ শোনা গেলেও মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারের ইএমএফের উচ্চ তেজস্ক্রিয় তরঙ্গ বিকিরণের ক্ষতিকর মাত্রা নিয়ে কথা বলা হয়েছে খুব কম; বিষয়টি নিয়ে রয়েছে বিতর্কও।

গত বছর নভেম্বরে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বাংলাদেশে স্মার্টফোনের বাজারের আকার ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল আকারের বাজার থেকে দেশে প্রতি বছর গড়ে ১১ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়। এতে করে বায়ুদূষণ, জীববৈচিত্র্য ও মানবস্বাস্থ্য ব্যাপক ঝুঁকিতে পড়ছে বলে দাবি করে সংস্থাটি।

তবে ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর দিকের কথা উল্লেখ করলেও দেশের মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর যত্রতত্র মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার স্থাপনের ফলে অত্যাধিক মাত্রায় ইএমএফের তেজস্ক্রিয় তরঙ্গ বিকিরণের কারণে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কি-না, সে বিষয়ে কিছু জানায়নি সংস্থাটি। অথচ এর ক্ষতিকর প্রভাব একেবারেই দৃশ্যমান।

২০১৮ সালে বিবিসি বাংলার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সারাদেশে মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠান রবি, এয়ারটেল, টেলিটক, গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকের আওতায় অন্তত ৪০ হাজার মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ার রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এই সংখ্যা যে ২০২৫ সালের শেষে এসে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ৭ বছরে যে পরিমাণ মোবাইল ও সিম ব্যবহারকারী বেড়েছে তার সাথে একটু তুলনা করলেই সহজে বোঝা যায় কি পরিমাণ মোবাইল টাওয়ার বৃদ্ধি পেয়েছে।

মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে নানা সময়ে হয়েছে বিভিন্ন গবেষণা। পদার্থবিদ, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন প্রতিরক্ষা কমিশন (আইসিএনআইআরপি) পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারগুলো হতে ইএমএফের ক্ষতিকর তরঙ্গ বিকিরণের মাত্রা ১০ মেগাহার্টজের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। তবে ব্যবহারকারীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যা এবং সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক প্রদানে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো দীর্ঘদিন ধরে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি হারে তরঙ্গ বিকিরণ করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও কম বনাঞ্চলবিশিষ্ট দেশের জন্য এই হার হওয়া উচিত ছিল ১০ মেগাহার্টজের চেয়েও নিচে।

২০২৪ সালের অক্টোবরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় জার্নালে প্রকাশিত ‘ইফেক্টস অব নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন অব সেল টাওয়ার অ্যান্ড হাই ভোল্টেজ ট্রান্সমিশন লাইন অন প্ল্যান্টস, অ্যানিমেলস, হিউম্যান’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে দেশের সাতটি বিভাগে ৭৬টি মোবাইল টাওয়ার হতে ইএমএফ তরঙ্গ বিকিরণের হার পর্যবেক্ষণ করে জানানো হয়, এর সবকটিতেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অধিক মাত্রায় তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরিত হচ্ছে। যা মানবদেহ এবং পরিবেশের জন্য বড় আকারের সংকট তৈরি করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়।
২০২২ সালে প্রকাশিত ‘মোবাইল ফোন অ্যান্ড বেইজ স্টেশন রেডিয়েশন অ্যান্ড ইটস ইফেক্টস অন হিউম্যান হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ নামের আরেকটি গবেষণায় ভারতের যোগী ভেমানা বিশ্ববিদ্যালয়, এসভি বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতীয় কেমিক্যাল টেকনোলজি ইনস্টিটিউট ও আনন্দপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের ছয়জন গবেষক মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারগুলো হতে ইএমএফের ক্ষতিকর তরঙ্গ বিকিরণের প্রভাবগুলো তুলে ধরেন বিস্তারিতভাবে।

গবেষণাটিতে দেখানো হয়, মোবাইল টাওয়ার হতে অত্যাধিক ক্ষতিকর তরঙ্গ বিকিরণের ফলে মানব মস্তিষ্কের কোষ বিভাজন অস্বাভাবিক হয়ে রক্তনালিগুলো দুর্বল হয়ে ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি তৈরি করছে। একইভাবে, পুরুষদের বন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার হারও মোবাইল রেডিয়েশনের কারণে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। তবে সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ওপর।

বিশেষ করে পাঁচ ও ১০ বছর বয়সী শিশুদের বর্ধিষ্ণু মস্তিষ্ক ৭৫ ও ৫০% বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায়। এ ছাড়া, অতিরিক্ত তড়িচ্চুম্বকীয় রশ্মি বিকিরণ গর্ভবতী নারীদের অমরা এবং ভ্রূণের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে পারে বলে গবেষণায় উঠে আসে।

অপর দিকে, মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারগুলো হতে ইএমএফের ক্ষতিকর তরঙ্গ বিকিরণের ফলে মৌমাছি, পাখি এবং উদ্ভিদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দৃশ্যও একই গবেষণায় উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে উচ্চ মাত্রার তরঙ্গ বিকিরণের ফলে মৌমাছির কলোনি কলাপস ডিজঅর্ডার (সিসিডি) এবং দেহের কোষীয় ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।

একইসঙ্গে, উচ্চ ইএমএফের উপস্থিতিতে পাখিদের জীবনও তীব্রভাবে বিপন্ন হচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে দুর্বল ইএমএফের সহায়তায় পাখি আকাশে উড়ে বিভিন্ন স্থানে গমন করলেও, মোবাইল টাওয়ারের শক্তিশালী তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণের কারণে তারা এখন দিগভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। কোষীয় ভারসাম্যহীনতায় খোয়াচ্ছে প্রাণও।

পাশাপাশি, মোবাইল টাওয়ারের শক্তিশালী তড়িচ্চুম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে গম ও ভুট্টার মতো প্রয়োজনীয় ফসলের উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এমনকি বড় বড় বৃক্ষের বীজ, চারা, মূল ও কাণ্ডের বিকাশ পর্যন্ত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপক খাদ্য সংকট সৃষ্টি ত্বরান্বিত করতে পারে। ফলে সমগ্র বিষয়াদি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য নতুন ঝুঁকির জন্ম দিচ্ছে।

এমতাবস্থায়, জীববৈচিত্র্য এবং দেশের জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) নিয়মিত দেশের স্থাপিত মোবাইল টাওয়ারগুলোতে অভিযান চালিয়ে নির্ধারিত সীমার মধ্যে ইএমএফ তরঙ্গ বিকিরিত হচ্ছে কি-না তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, অপ্রয়োজনীয় মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্যবহার বন্ধে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা যেতে পারে।

পাশাপাশি, অপ্রাপ্তবয়স্ক বিশেষ করে ১০ বছরের কম বয়স্ক শিশুদের প্রয়োজন ব্যতিরেকে ফোন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ জটিল ও সময়সাপেক্ষ বলে মনে হলেও, সুন্দর বাসযোগ্য দেশ বিনির্মাণে এটিই আমাদের একমাত্র করণীয়।