/
/
/
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা: তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা: তুলনামূলক বিশ্লেষণ
Byআরিয়ানা আহমেদ মাইশা
Published১৭ আগস্ট, ২০২৫
৫:১২ অপরাহ্ণ
WhatsApp Image 2025-08-15 at 6.44.40 PM
আরিয়ানা আহমেদ মাইশা
আরিয়ানা আহমেদ মাইশা নিউ ইয়র্ক সিটির লিডারশিপ অ্যান্ড পাবলিক সার্ভিস হাই স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং বাংলাদেশি-আমেরিকান। সে লাল সবুজ সোসাইটিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছে এবং বর্তমানে নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে তরুণদের কমিউনিটি উন্নয়নে সম্পৃক্ত করছে।

কনটেন্টটি শেয়ার করো

Copied!

সর্বশেষ

Untitled design (10)

একটি দেশের উন্নয়নের জন্য শিক্ষাই মূল চাবিকাঠি। যে দেশের মানুষ যত বেশি শিক্ষিত, সে দেশ তত বেশি উন্নত। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে, যদি দেশকে উন্নত করতে চাও, তাহলে তার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর মনোযোগ দাও। আমি আরিয়ানা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের একজন শিক্ষার্থী। এর আগে আমি বাংলাদেশে পড়াশোনা করেছি। প্রাক-বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমি সেখানেই ছিলাম। একারণে, সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি পরিবেশে আমার পড়াশোনা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। অবশ্য শুধু ‘ভিন্ন’ পরিবেশ বললে ভুল হবে, বরং দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা ও পরিবেশে আমার পড়াশোনা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।

প্রথমেই শুরু করি বাংলাদেশের পাঠ্যক্রম দিয়ে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যক্রম সবার জন্য বেশ নির্দিষ্ট, যার অর্থ হলো সকল শিক্ষার্থীই বোর্ডের দেওয়া বিষয়গুলো পড়তে বাধ্য। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও স্নাতকের জন্য কিছু আবশ্যক বিষয় পড়তে হয়, যেমন: গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি ইত্যাদি। তবে এর বাইরেও শিক্ষার্থীরা তাদের আগ্রহ অনুযায়ী অন্যান্য বিষয় বেছে নিয়ে পড়তে পারে, তবে এর আগে অবশ্যই তাদের আবশ্যিক বিষয়গুলোতে পাশ করা বাধ্যতামূলক। এটা কি কঠিন? উত্তর— হ্যাঁ অবশ্যই! কিন্তু সব বিষয় শেষ করার জন্য কি তারা পর্যাপ্ত সময় পায়? উত্তর— হ্যাঁ, পায়। তবে, অন্য দেশের মানুষ যখন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ভাবে, তখন তারা মনে করে এখানে হয়তো সবকিছুই খুব সহজ এবং মজার। কিন্তু এটি আসলে সত্য নয়। কারন, আমাদের বুঝতে হবে, মোটামুটি সারা বিশ্ব থেকেই মানুষ এখানে পড়তে আসে এবং বেশিরভাগ সময়ই তারা বিভিন্ন স্কলারশিপে আসে, যার অর্থ হলো তারা নিঃসন্দেহে খুবই মেধাবী শিক্ষার্থী। আর একারণেই এখানে প্রতিযোগিতাটা-ও বিশাল।

আবার, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশেই শিক্ষক-নির্ভর। এখানে শিক্ষার্থীরা কিছু শেখার জন্য শিক্ষকের ওপরই শতভাগ নির্ভরশীল হয়ে থাকে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ব্যবহারিক কাজের মাধ্যমে তাদের পাঠগুলো শেখে। তবে এটাও কি কঠিন? উত্তর— হ্যাঁ, কঠিন। যেমন, ভালো কলেজে ভর্তির জন্য এখানে বাধ্যতামূলকভাবে ‘কমিউনিটি সার্ভিস আওয়ার’ পূরণ করতে হয়, যেটি মোটেও সহজ নয়। এটি এমন একটি বিষয় যা অনেক শিক্ষার্থীর জন্যই খুঁজে বের করা কঠিন এবং অর্জন করা আরও কঠিন। কারণ বেশিরভাগ সময়ই স্বেচ্ছাসেবকদের একটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয়, আর এই স্বেচ্ছাসেবক আওয়ারগুলো স্নাতকের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশেও সহশিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে, তবে সেগুলো বেশিরভাগ সময়ই কেবল মজা বা আইইএলটিএস বা অন্য কোনো স্বীকৃতির জন্য হয়ে থাকে। এছাড়াও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের প্রায় সবকিছুতেই একটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, কারণ এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই, কর্তৃপক্ষ আবেদনকারী সবাইকে এলোমেলোভাবে বেছে নিতে পারে না।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আরও একটি কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব ভিন্ন। বাংলাদেশে সাধারণত স্কুলে শিক্ষাবর্ষের একদম শেষদিকে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং সেই পরীক্ষাগুলোর প্রাপ্ত নম্বরই তাদের চূড়ান্ত গ্রেড হিসেবে বিবেচিত হয়। সুতরাং, এখানে ক্লাসে উপস্থিতি তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন স্কুলে আসা আবশ্যক এবং এটি ছাড়া কোনো শিক্ষার্থীই তার ক্লাসে পাশ করতে পারে না বা কোনোভাবেই স্নাতকে ভর্তি হওয়ার শর্ত পূরণ করতে পারে না। পাশাপাশি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের প্রচুর অ্যাসাইনমেন্ট থাকে এবং তাদের সেগুলো অবশ্যই শেষ করতে হয়। কারণ, সেই এ্যাসাইনমেন্ট গুলোই বছরের শেষে তাদের চূড়ান্ত গ্রেড হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘রিজেন্টস এক্সাম’ নামে একটি চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে হয়। এবং এই চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাশ করা শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক থাকে। আর যদি তারা ফেল করে, তবে তাদের স্নাতকের শর্ত পূরণ করার জন্য পরের বছর সেই একই বিষয় আবার পড়তে হয়।

আমি এতক্ষণ স্নাতকের শর্ত নিয়ে কথা বললাম, তো চলুন এখন জেনে নিই স্নাতকের শর্ত আসলে কী। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সাধারণত দশম শ্রেণি পর্যন্ত “স্কুলে” থাকে, তারপর তারা “এসএসসি পরীক্ষা” নামে একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা দেয়। এরপরে ২ বছরের জন্য কলেজে যায় এবং তারপর আবার “এইচএসসি পরীক্ষা” নামে আরেকটি চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীরা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে থাকে, যেখানে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বলা হয় ফ্রেশম্যান, দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বলা হয় সোফমোর (যেমন- আমি), একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বলা হয় জুনিয়র এবং দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সিনিয়র। এখানে, হাইস্কুলের এই চার বছরে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যাতে তারা তাদের স্নাতকের শর্ত পূরণ করতে পারে। এই গ্র্যাজুয়েশনের শর্তগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক থাকে এবং এটি না শেষ করতে পারলে, শিক্ষার্থীরা কোনো ভালো কলেজে যেতে পারে না।

এবার চলুন এই দুই দেশের প্রযুক্তি নিয়ে কথা বলা যাক। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সাধারণত কলেজ পর্যন্ত ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের প্রয়োজন হয় না। কিছু উচ্চমানের স্কুলে হয়তো প্রয়োজন হতে পারে, তবে আমি বলছি বাংলাদেশের সাধারণ স্কুলগুলোর কথা। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনার জন্য একটি ল্যাপটপ থাকা বাধ্যতামূলক। এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে: সবাই কি সেখানে ল্যাপটপ কিনতে পারে? এর উত্তর হলো, পারে না। আর এই সমস্যার জন্য এখানকার স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের বাড়িতে ব্যবহারের জন্য স্কুলের ল্যাপটপ নিতে দেয়। কিন্তু এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে যা অবশ্যই শিক্ষার্থীদের মেনে চলতে হয়। যেমন— এই ল্যাপটপগুলোতে কোনো গেম, ভিপিএন বা মনোযোগ বিঘ্নিত হয় এমন কিছু ডাউনলোড করা সম্ভব হয় না। এছাড়াও, বছরের শেষে শিক্ষার্থীদের সেই ল্যাপটপটি কর্তৃপক্ষকে ফেরত দিতে হয়, কারণ এটি সরকারের সম্পত্তি। এভাবেই মার্কিন সরকার নিশ্চিত করে যে, তার দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থী প্রযুক্তি সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা একে অপরের থেকে একেবারেই ভিন্ন, তবে এটি আসলে মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো— শিশুদের এবং শিক্ষার্থীদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া, তাদের কথার মূল্য বোঝা, সুস্থ্য ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া এবং সবসময় পাশে থাকা। কেননা, এরাই বড় হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং উন্নত করবে। সুতরাং, কোন দেশ ভালো, সেটি আসলে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো কোন দেশ শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করে এবং তাদের মূল্য বোঝে। কিন্তু দেখা যায় যে, আমাদের বর্তমান বিশ্বের সমস্যা হলো তুলনা করা। অথচ, আমাদের একে অপরের সাথে তুলনা না করে, মূল জিনিসের ওপরই বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত, আর সেটি হলো সবার জন্য বিনামূল্যে একটি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। কেননা, যদি কোনো দেশ এটি সফলভাবে করতে পারে, তবেই সেটি দেশ হিসাবে সফল বিবেচিত হয়।