/
/
/
নিজের বাল্য বিয়ে বন্ধ করা আনিকার মাসে আয় লাখ টাকা
নিজের বাল্য বিয়ে বন্ধ করা আনিকার মাসে আয় লাখ টাকা
Byকারিমা ইসলাম
Published২৩ আগস্ট, ২০২৫
২:২৩ অপরাহ্ণ
Karima
কারিমা ইসলাম
কারিমা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-এর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী এবং লাল সবুজ প্রকাশের ফিচার লেখক। সে লেখালেখির মাধ্যমে বৈশ্বিক সমস্যা, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তরুণদের সচেতন করতে কাজ করে। তার স্বপ্ন লেখার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তরুণদের সংযুক্ত করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা।

কনটেন্টটি শেয়ার করো

Copied!

সর্বশেষ

WhatsApp Image 2025-08-23 at 14.13.58_73a2da4a

যে সমাজে বাল্যবিবাহ একটি স্বাভাবিক চিত্র, সেখানেই এক ব্যতিক্রমী গল্প লিখেছে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধের আনিকা। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই নিজের বিয়ে রুখে দিয়ে সে প্রমাণ করেছে, সংগ্রাম শুরু হওয়া উচিত নিজের থেকেই।

সংগ্রামের সূচনা:

মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ, যেখানে জীবনের গতিপথ নির্দিষ্ট আর স্বপ্নগুলো ধূসর, সেখানেই সূচনা এক ভিন্ন গল্পের। গল্পটা আনিকার— যে নিজেই নিজের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেছিলো এবং শুধু সেখানেই থেমে থাকেনি, রোধ করেছিলো আরও ১৯টি বাল্যবিবাহ।

জন্ম জামালপুরে, বাবা একজন সাধারণ মুদি দোকানি, মা গৃহিণী। ছোট্ট আনিকার জীবনটাও হয়তো আর দশটা মেয়ের মতোই হতো, যদি সে-ও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতো। কিন্তু আনিকা সেটি না করে বরং এই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। ছোট্ট আনিকা তখনো বুঝত না কী বিপদ সামনে আসছে, শুধু জানত, এটা ভুল। তাই, ‘১০৯’ নম্বরে ফোন করে সে পুলিশ আর একটা এনজিওর সাহায্যে নিজেই নিজের বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিলো।

সেখান থেকেই শুরু। এর পর থেকে যেখানেই বাল্যবিবাহের খবর পেয়েছে আনিকা, সেখানেই ছুটে গেছে, কখনো একা, কখনো বা তারই মতো অন্যদের সাথে। সমাজের কটূক্তি, প্রতিবেশীদের ঘৃণা, এমনকি শারীরিকভাবে হেনস্তা— কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারেনি।

আনিকা বলে, যাদের বিয়ে সে বন্ধ করেছিলো, তারা এখন তাকে বলে, “আপনি যদি ঠিক সময়ে সাহায্য না করতেন, আমার জীবনটা হয়তো নষ্ট হয়ে যেত। এখন আমি অনেক ভালো আছি।” অন্যদিকে, ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যাওয়া তার অন্য এক বান্ধবী তাকে বলে, “তুই অনেক ভালো আছিস, আমার সংসারে অনেক সমস্যা।” সে জানায়, এই ঘটনাগুলো তাকে আরও বেশি করে স্বাবলম্বী হওয়ার গুরুত্ব শিখিয়েছে। আনিকার মতে, “জীবনে ভালো থাকতে হলে স্বাবলম্বী হওয়া অপরিহার্য্য।

উদ্যোক্তা জীবন:

২০২২ সালে আনিকা ভাবলো, এবার নিজের জীবনের হাল সে নিজেই ধরবে। তাই, ছোটবেলার হাতে আঁকার শখটাকেই সে নিজের পেশা হিসাবে নিতে চাইলো। পেইন্টিং এবং হাতের কাজে সে ছিলো খুবই দক্ষ। তার হাতের ছোঁয়ায় সাধারণ কাঠ, মেটাল আর কাঁচের জিনিসপত্র হয়ে উঠতো অসাধারণ। অতঃপর, ‘গয়না সুন্দরী’ নামে সে ফেইসবুকে একটি পেজ খুললো এবং ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে নিজের হাতে বানানো গয়নাগুলো নিয়ে তার ব্যবসা শুরু করলো। দেখতে দেখতেই তার বানানো গয়নাগুলো জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করলো। প্রথমবার যখন ১,০০০ টাকার পণ্য সে ৮,০০০ টাকায় বিক্রি করলো, তখনই তার মনে হলো, চাকরি নয় বরং ব্যবসা নিয়েই সে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। আনিকা জানায়, “যখন তুমি ব্যবসা করবে, তখনই তুমি লাখপতি বা কোটিপতি হতে পারবে এবং অন্যকে সাহায্য করতে পারবে।

আজ আনিকার ব্যবসা শুধু তার একার নয়। এটি এখন ১৮টি পরিবারের একটি ভরসার জায়গা। আনিকা নিজেই প্রশিক্ষণ দিয়েছে এমন ১৫ জন নারীকে যারা নিজেদের কাজ দিয়ে এখন স্বাবলম্বী হয়েছে। আনিকা জানায়, “তারা এখন তাদের পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারছে।

আনিকার মোট কর্মী ১৮ জন, যার মধ্যে ১৫ জন নারী এবং ০৩ জন পুরুষ। তাদের ১০ জন পণ্য তৈরি করে এবং ৮ জন পণ্যগুলো শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্রি করে। তার দলটা যেন এখন একদল স্বপ্নবাজ মানুষের ছোট্ট সংসার। আনিকার বর্তমান মাসিক মুনাফা এখন প্রায় এক লাখ টাকা, যা দিয়ে সে তার পরিবারকে সহযোগিতা করছে।

ভবিষ্যৎ ভাবনা:

আনিকার পরিকল্পনা এখন আরও বড়। সে বিশ্বাস করে, ব্যবসার মাধ্যমেই সে সমাজের ওপর সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে। তার ইচ্ছা, ভবিষ্যতে সে এমন সব নারীদের কাজের সুযোগ করে দেবে যারা সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। শুধু নারীরাই নয়, যে শিশুরা ঝরে পড়েছে, যাদের জীবনে কোনো পথ নেই, তাদের জন্যও আনিকা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান তৈরি করতে চায়। এই লক্ষ্যেই ২০৩০ সালের মধ্যে একটি স্থায়ী শোরুম খোলার স্বপ্ন দেখে আনিকা।

আনিকার গল্পটা শুধুমাত্র বাল্যবিবাহ ঠেকানো বা সফল উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প নয়। বরং এটা একজন নারীর ভেতরকার অদম্য শক্তির গল্প। যে মেয়েটা একদিন নিজের জন্য লড়েছিল, আজ সে আরও ১৮টি পরিবারকে সাহস আর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আনিকা প্রমাণ করেছে, জীবনের সবচেয়ে বড় ভাঙন থেকেও সবচেয়ে সুন্দর কিছু গড়ে তোলা যায়। তার গল্পটা যেন আঁধারে আলোর ঝলক, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।

আনিকার দৃঢ় কন্ঠে বলা একটি কথাই তার জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে যেনো কাজ করে চলেছে: “সব শিশুই যেনো থাকে মায়ের কোলে, শিশুর কোলে যেনো কোনো শিশু না থাকে।