

বরিশাল অঞ্চলের রয়েছে প্রশিদ্ধ ইতিহাস, যার একটি অন্যতম অংশ এই অঞ্চলের পুরাকীর্তিসমূহ। ঝালকাঠি জেলার কীর্তিপাশা জমিদারবাড়ী, প্রাচীন স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন।
সেনগুপ্ত বংশের এক বংশধর দেওয়ান কৃম্রাম সেনগুপ্ত এর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও দানশীলতার জন্য রাজা রাজনারায়ন এর পক্ষ থেকে জমিপ্রাপ্ত হন এবং সেই সাথেই কীর্তিপাশা জমিদারবাড়ীর সূচনা হয়। এই জমিদারদের বংশানুক্রমিক দানশীলতা, পরোপকার ও মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায়। শিল্পসাহিত্যের প্রতি এই অঞ্চলের জমিদারদের অনুরাগের কথা জানা যায়। সমস্ত বাংলায় সেই সময় দুইটি নাট্যমঞ্চ ছিল। যার একটি এই জমিদার বাড়িতে, অন্যটি কলকাতায়।
এখানে, দুইটি সহমরনের ঘটনা আছে বলে জানা যায়, যা এর ঐতিহ্য কিছুটা মলিন করে। এছাড়াও এখানে রয়েছে, ঘোষাল রাজার বাড়ি, সুতালরির মন্দির, সাহেব বাড়িসহ আরো অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই সাহেব বাড়ির ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে নীলকুঠির নির্মম কাহিনী। ঝালকাঠির রাজাপুরেও আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও এর স্থাপত্যশৈলী। ছুরিচোরা হাওলাদারবাড়ি মসজিদ, গালুয়া মসজিদ, পালবাড়ি দুর্গা মন্দির ও মনসা মন্দির এবং ঝালকাঠি জেলার সবচেয়ে পুরোনো বাড়ি, মিরাবাড়ি।
ঐতিহ্যবাহী এইসকম স্থাপনার বেশিরভাগই বিলুপ্তির পথে। এছাড়া ঝালকাঠি সদর উপজেলার কাপুরিয়া বাড়ির সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পাক হানাদার বাহিনী এ বাড়িটাকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করত। ঝালকাঠি বিখ্যাত ছিলো এদেশের “কলকাতা” অর্থাৎ বানিজ্যিক শহর হিসেবে। ব্রিটিশ আমলে সুদূর চীন থেকে এদেশে এসে ব্যবসা করত চীন ব্যবসায়ীরা যাদের সমাধি চিনা কবর হিসেবে পরিচিত। ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী এই স্থাপনাসমূহ এখন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। চায়ের স্টল, রিকশার স্টান্ড ও নানা আবর্জনার স্তুপ এ চাপা পড়েছে এই এলাকার গর্বিত ইতিহাস।
এছাড়া পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার তেওয়ারি জমিদারবাড়ি, খানবাড়ি মসজিদ এবং মোঘল আমলে নির্মিত ইন্দ্রপাশা কেল্লা এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বাংলায় পর্তুগীজদের আগমনের পর, তাদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ইন্দ্রপাশা নদীর তীরে কেল্লা নির্মান করা হয়। অসচেতন নাগরিকের না বুঝে মাটি কেটে নেয়া, রক্ষনাবেক্ষনের অভাব ও প্রাকৃতিক বৈরীতা মুলত এই স্থাপনাসমুহ বিলুপ্তির কারন। শুধুমাত্র ঝালকাঠি কিংবা পিরোজপুর নয়, পুরো বরিশাল বিভাগেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা ও এর সমৃদ্ধ ইতিহাস।
নগরায়ন ও আধুনিকায়নের কারনে শহরজুড়ে গড়ে উঠছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক স্থাপনা। এই সকল স্থাপনা ও আধুনিকায়নের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে বহুবছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। এই স্থাপনাসমুহ রক্ষনাবেক্ষন করে, তা জনগনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া যেতে পারে। এতে একাধারে যেমন, আমাদের প্রাচীন সমৃদ্ধ ইতিহাসের নবজাগরন হবে, সেই সাথে বরিশালের বিনোদন কেন্দ্র ও বৃদ্ধি পাবে। ইতিহাস বিভাগ, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগসহ সংশ্লিষ্ঠ অন্যান্য বিভাগ এই বিষয়ে গবেষনা ও মাঠ পর্যায়ের কাজের ক্ষেত্র বৃদ্ধি করতে পারে। এতে করে প্রাচীন ইতিহাস ও এর রক্ষনাবেক্ষনের ক্ষেত্র ও তাৎপর্য সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া, এলাকার শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ এই প্রাচীন পুরাকীর্তি রক্ষনাবেক্ষন এ কার্যকরী ভুমিকা রাখতে পারে।
অনেক সময় পরিত্যাক্ত এইসকল স্থাপনায় মাদকগ্রহনসহ অন্যান্য অবৈধ কার্যক্রম ঘটতে পারে। সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমুহ এর রক্ষনাবেক্ষনে এগিয়ে আসতে পারে। এলাকার যুবসমাজকে কাজে লাগিয়ে এইসকল প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনসমূহ পরিচ্ছন্নকরণ, ইতিহাস পুনরুদ্ধার, পর্যটন কেন্দ্র সৃষ্টিকরন ও রক্ষনাবেক্ষনের কাজ করানো যেতে পারে। এতে করে একাধারে বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস সকলের দৃষ্টিগোচর হবে, বরিশালের পর্যটনকেন্দ্র বাড়বে ও এলাকার যুবসমাজের বেকারত্বের সমাধান হবে।