/
/
/
অন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ: মানসিক চাপ কমানোর এক নীরব কৌশল
অন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ: মানসিক চাপ কমানোর এক নীরব কৌশল
Byরুশাইদ আহমেদ
Published১৩ নভেম্বর, ২০২৫
১২:০৫ অপরাহ্ণ
আরইউএস_21
rusaid
রুশাইদ আহমেদ অধ্যয়ন করছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। উন্নয়ন, মানবাধিকার, যোগাযোগ, ভূরাজনীতিসহ বিবিধ বিষয়ে তিনি দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে নিয়মিত লেখালেখি করে থাকেন। সাংবাদিকতা এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের ওপরও রয়েছে তাঁর তুমুল ঝোঁক।

কনটেন্টটি শেয়ার করো

Copied!

সর্বশেষ

intra

মানুষ আজ এক যান্ত্রিক সময়ে বাস করছে৷ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের তীব্র স্রোতে যেখানে জীবনের গতি দ্রুত, কিন্তু মন ক্রমশ ভারাক্রান্ত। পেশা, পরিবার, সম্পর্ক, আর্থ-সামাজিক টানাপোড়েন কিংবা ব্যক্তিগত সংকট—সব মিলিয়ে এক অদৃশ্য মানসিক চাপ জেঁকে বসেছে আধুনিক মানুষের জীবনে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক জরিপে জানিয়েছে, বর্তমানে বিশ্বে একশ’ কোটিরও বেশি মানুষ মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। একইসঙ্গে, ২০২১ সাল পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন ৭ লাখ ২৭ হাজার মানুষ—শুধু মানসিক চাপের ভার সহ্য করতে না পেরে।

এমনকি, সারা বিশ্বে এখন প্রতিটি আত্মহত্যার বিপরীতে ২০ জন ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন বলে দাবি করেছেন ডব্লিউএইচওর অ-সংক্রামক রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ডেভোরা কেস্টেল (জাগোনিউজ২৪, ২০২৫)।

এই পরিসংখ্যান শুধু মানসিক রোগের ভয়াবহতা নয়, বরং “যান্ত্রিক সামাজিকতা”র যুগে অন্তর্দৃষ্টি হারানোর সংকটও প্রকাশ করে। ফলে আমরা যতই বাহ্যিক যোগাযোগে ব্যস্ত হচ্ছি, নিজের সঙ্গে যোগাযোগ ততটাই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। অথচ নিজের সঙ্গে গঠনমূলক অন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ মানসিক চাপ লাঘবে কার্যকর এক মন্ত্র হতে পারে।

অন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ আসলে কী?

সাধারণভাবে, অন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ (Intrapersonal Communication) হলো নিজের সঙ্গে নিজের ভাব বিনিময়—চিন্তা, অনুভূতি ও আত্মমূল্যায়নের ভেতর দিয়ে নিজেকে ও নিজের পরিবেশকে বোঝার প্রক্রিয়া।

‘ইন্ট্রাপারসোনাল কমিউনিকেশন: ডিফারেন্ট ভয়েসেস, ডিফারেন্ট মাইন্ডস’ (১৯৯৪) গ্রন্থে ইউনিভার্সিটি অব কলোরেডোর সাবেক অধ্যাপক ডোনা আর. ভোকেট এই প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন এমনভাবে: “একজন ব্যক্তি তাঁর চেতন ও অবচেতন মনে যে শারীরবৃত্তীয় ও মানসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের সঙ্গে বার্তা আদান-প্রদান করে নিজেকে বুঝতে চান, সেটিই হলো অন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ।”

অর্থাৎ, এটি এমন এক অভ্যন্তরীণ সংলাপ যা মানুষকে আত্মসমালোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

সংকটের সময় ‘স্ব-কথন’ হতে পারে সান্ত্বনা

অনেকেই একা একা কথা বলাকে নেতিবাচকভাবে দেখেন। কিন্তু গঠনমূলকভাবে নিজের সঙ্গে আলাপ মানসিক স্বস্তির এক বাস্তব উপায়।
যখন কেউ সংকটে পড়ে নিজের সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত হয়ে ‘সমস্যা আসলেই কোথায়’, ‘সমাধান কী হতে পারে’—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজে, তখন তার মন ধীরে ধীরে বিশ্লেষণক্ষম হয়ে ওঠে। এই স্ব-কথন (self-talk) আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা শাণিত করে, এবং জটিল চিন্তনক্ষমতাকে সক্রিয় করে তোলে।

স্ব-মূল্যায়ন ও আত্মসমালোচনার ভারসাম্য

নিজের কাজ, সক্ষমতা, ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করার নাম স্ব-মূল্যায়ন। এটি আত্মসচেতনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
তবে অতিরিক্ত আত্মসমালোচনা মানসিক চাপ বাড়িয়ে তুলতে পারে। যেমন, একজন শিক্ষার্থী যদি বারবার মনে করেন “আমি পারব না”, তাহলে সেই চিন্তাই তার পারফরম্যান্স নষ্ট করে দিতে পারে।
অতএব, মানসিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য দরকার বাস্তবতানির্ভর আত্মমূল্যায়ন এবং গঠনমূলক আত্মসমালোচনার মধ্যে সুষম সম্পর্ক।

স্ব-ধারণায়ন: নিজের দর্শন গড়ে তোলার পথ

অন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগের একটি শক্তিশালী উপাদান হলো স্ব-ধারণায়ন (self-conceptualization)।
অতীত অভিজ্ঞতা, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও সম্পর্কের আলোকে যখন কেউ নিজের জীবনদর্শন বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গড়ে তোলেন, তখন তিনি এক ধরনের “সেলফ-ইমেজ” নির্মাণ করেন।
এই প্রক্রিয়া মানুষকে সংকটের সময়ে বাস্তবতার নিরীক্ষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।
তবে এই আত্মচেতনা যেন অহংবোধে পরিণত না হয়—সেই বিষয়ে সতর্ক থাকাও জরুরি।

আত্মউন্নয়নের সোপান: স্ব-প্রতিফলন

নিজের চিন্তা, অনুভূতি ও আচরণের ওপর অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের নাম স্ব-প্রতিফলন (self-reflection)। এটি এক ধরনের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন, যা মানুষকে উন্নতির পথে চালিত করে।
সংকটের সময় কেউ যখন নিজের প্রতিক্রিয়া ও চিন্তা বিশ্লেষণ করেন, তখন তিনি নিজের মানসিক গতিপথও বুঝতে শেখেন। এই অভ্যাস কর্মজীবন থেকে ব্যক্তিগত জীবন—সবক্ষেত্রেই আত্মউন্নয়ন ঘটায়।

মানসিক চাপ কমাতে অন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ করবেন কীভাবে?

মানসিক চাপ মোকাবেলায় অন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগের পাশাপাশি কয়েকটি বাস্তব অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে:

• মেডিটেশন: মনের অস্থিরতা প্রশমিত করে আত্মসচেতনতা বাড়ায়।

• ডায়েরি লেখা: দিনের কাজ ও অনুভূতির প্রতিফলন ঘটায়, যা স্ব-মূল্যায়নে সহায়ক।

• ভিজ্যুয়ালাইজেশন: সংকটমোচনের সম্ভাব্য চিত্র কল্পনা করে মানসিক প্রস্তুতি তৈরি করে।

• ধর্মীয় প্রার্থনা বা মনন: নিজের পরিস্থিতি স্রষ্টার কাছে তুলে ধরলে মানুষ এক ধরনের আবেগীয় মুক্তি অনুভব করে।

এই অভ্যাসগুলো মানুষকে নিজের ভেতরকার সত্তার সঙ্গে যুক্ত হতে সাহায্য করে, যা মানসিক চাপ হ্রাসে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর।

শেষ কথা

অন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ এক নীরব অনুশীলন—যেখানে মানুষ নিজের ভেতরেই খুঁজে পায় উত্তর, শান্তি এবং দিকনির্দেশনা।
তবে দুশ্চিন্তা, হ্যালুসিনেশন বা অস্বাভাবিক দৃশ্যায়নের মতো ক্ষতিকর চিন্তাপ্রবণতা দেখা দিলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

একই সঙ্গে কাছের মানুষদের সঙ্গে খোলামেলা যোগাযোগও রাখতে হবে—কারণ, নিজের সঙ্গে সম্পর্ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অন্যের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াও মানসিক স্বাস্থ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।