

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মুসলিম উম্মাহর কাছে এক বিশেষ দিন। এ দিনটি বিশ্ব মুসলিম সমাজের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও স্মৃতিময়। কারণ, এ দিনেই জন্ম নিয়েছিলেন মানবজাতির পরম করুণাময় প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল, আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। একই দিনে তাঁর ইন্তেকালও সংঘটিত হয়। তাই দিনটি মুসলমানদের কাছে একদিকে যেমন আনন্দ ও খুশির দিন, অন্যদিকে তা বেদনারও স্মারক।
মক্কার কুরাইশ বংশে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে (হাতির বছর) হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের আগেই তিনি পিতৃহারা হন, এবং অল্প বয়সে মাতৃহারা হয়ে এতিম জীবনের কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন। শৈশবে তিনি তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিবের আশ্রয়ে বড় হন। ছোটবেলা থেকেই তিনি সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ও সততার জন্য পরিচিত ছিলেন। এ কারণে মক্কার মানুষ তাঁকে “আল-আমিন” (অত্যন্ত বিশ্বস্ত) এবং “আস-সাদিক” (সত্যবাদী) উপাধিতে ভূষিত করেন।
শৈশব থেকেই তাঁর জীবনে দরিদ্রতা, কষ্ট ও সংগ্রামের ছাপ ছিল, কিন্তু তা কখনো তাঁর চরিত্রকে দুর্বল করেনি। বরং তিনি দয়া, সহানুভূতি ও মানবপ্রেমের গুণাবলীতে সজ্জিত হয়ে উঠেছিলেন।
৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় আল্লাহ তাঁকে নবুওয়াত দান করেন। প্রথম ওয়াহী নাযিল হয় “ইকরা” অর্থাৎ “পড়ো” শব্দ দিয়ে। এখান থেকেই শুরু হয় আল্লাহর একত্ববাদ, মানবকল্যাণ ও সত্যের দাওয়াত। তিনি মানুষকে তাওহীদের পথে আহ্বান করেন, শিরক ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেন।
নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে মক্কার কুরাইশরা তাঁর বিরোধিতা শুরু করে। তাঁকে নানা রকম নির্যাতন, সামাজিক বর্জন ও অত্যাচারের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু তবুও তিনি আল্লাহর দাওয়াত প্রচারে অবিচল ছিলেন। তিনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে, মিথ্যা থেকে সত্যের পথে আহ্বান করেছিলেন। তাঁর জীবনে ছিল কষ্ট, ত্যাগ ও সংগ্রাম, কিন্তু তিনি কখনো ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হননি।
‘ঈদ’ ‘মিলাদ’ ও ‘নবী’ এই তিনটি শব্দের সমন্বয়ে দিবসটির নামকরণ হয়েছে।
ঈদ অর্থ আনন্দ বা খুশি,
মিলাদ অর্থ জন্ম,
নবী অর্থ আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল বা বার্তাবাহক।
অতএব, ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থ দাঁড়ায় নবীর জন্মদিনের আনন্দোৎসব।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম শুধু মুসলিম জাহানের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্যই রহমত ও বরকতের নিদর্শন। তাঁর আগমনে পৃথিবী আলোকিত হয় এবং মানুষ মুক্তি পায় অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অন্ধকার থেকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তিনি ছিলেন মানবতার মুক্তিদাতা, ন্যায় ও শান্তির প্রতীক।
তিনি আরব সমাজের জাহেলিয়াত বা অজ্ঞতার অন্ধকার ভেঙে ন্যায়, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আলো ছড়িয়ে দেন। দাস প্রথা, নারী নির্যাতন, মূর্তিপূজা, অর্থনৈতিক বৈষম্য—এসবের বিরুদ্ধে তিনি দৃঢ় অবস্থান নেন এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলেন।
ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের গুরুত্ব বোঝাতে প্রাচীন আলেমরাও এর তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। প্রসিদ্ধ তাবেঈ হযরত হাসান বসরী (রাহ.) বলেছেন—
ﻭﺩﺩﺕ ﻟﻮ ﮐﺎﻥ ﻟﯽ ﻣﺜﻞ ﺟﺒﻞ ﺍﺣﺪ ﺫﮬﺒﺎ ﻓﺎﻧﻔﻘﺘﻪ ﻋﻠﯽ ﻗﺮﺍﺀﺓ ﻣﻮﻟﺪ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﯽ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ
অর্থাৎ— যদি আমার উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকত, তবে আমি তা রাসূলে পাক (সা.) এর জন্মদিন উপলক্ষে মাহফিলে খরচ করতাম। [সূত্র: আন-নেয়মাতুল কুবরা আলাল আলাম, পৃষ্ঠা-১১]
এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, আলেমরা নবীজীর জন্মোৎসবকে মহিমান্বিত করে দেখেছেন এবং এর মাধ্যমে মানুষকে তাঁর শিক্ষা স্মরণ করাতে চেয়েছেন।
বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় এ দিনকে বিভিন্নভাবে স্মরণ করে থাকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশে এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়—
মসজিদ ও মাদ্রাসায় কোরআন খতম,
দোয়া মাহফিল,
শানে রিসালাত আলোচনা,
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবনী পাঠ,
তাঁর মহান গুণাবলী ও দীন প্রতিষ্ঠার ত্যাগের কাহিনী প্রচার।
এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় মিছিল, শোভাযাত্রা ও মিলাদ মাহফিল আয়োজন করা হয়। অনেকেই এ দিন গরীব-দুঃখীদের মাঝে খাদ্য বিতরণ ও সেবামূলক কাজ করে থাকেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) দীর্ঘ ২৩ বছর নবুওয়াতের দায়িত্ব পালন শেষে ৬৩ বছর বয়সে, ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল ইন্তেকাল করেন। তাঁর ওফাতের মধ্য দিয়ে পৃথিবী হারায় মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ-ব্যক্তিত্বকে। সাহাবায়ে কেরাম গভীর শোকে মুহ্যমান হন, কিন্তু নবীজীর শিক্ষা তাঁদের সামনে আলোর দিশারী হয়ে থাকে।
ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আমাদের জন্য শুধু আনন্দের দিন নয়, বরং এটি হলো নবীজীর শিক্ষাকে হৃদয়ে ধারণ করার অঙ্গীকারের দিন। তাঁর দয়া, প্রেম, সহমর্মিতা ও সত্যনিষ্ঠতার আলোয় বিশ্বকে আলোকিত করাই এ দিনের আসল তাৎপর্য।
নবীজীর জন্মদিন উদযাপনের মাধ্যমে আমরা যেন তাঁর দেখানো সত্য, ন্যায়, শান্তি ও মানবপ্রেমের শিক্ষাকে জীবনে ধারণ করি— সেটাই হবে প্রকৃত ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন।